সারা বাংলা

বগুড়ায় জন্ম সনদ পেতে রাজ্যের ভোগান্তি

বগুড়ায় জন্ম ও মৃত্যু সনদ হাতে পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে দাড়িয়েছে। জন্মনিবন্ধনের আবেদন করার পর জন্মসনদ রেজিস্ট্রেশনের জন্য দিনের পর দিন পৌরসভার বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে সেবাগ্রহিতাদের। 

রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর সনদ হাতে পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে সেবাগ্রহিতাদের। ফলে ভোগান্তি আর হয়রানির সেবাগ্রহিতাদের সাথে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হরহামেশা বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে সৃষ্ট এমন সমস্যার পেছনে সার্ভার জটিলতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এ অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু শিশু সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করতে আসা অভিভাবকরা জন্ম সনদ হাতে পাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। 

জানুয়ারিতে ছেলেকে ভর্তি করাবেন শহরের মাসুদ নামের এক ব্যক্তি। ভর্তিতে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই গত দুই সপ্তাহ আগে ছেলের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেছেন তিনি। কিন্তু রোববার (৫ নভেম্বর) পর্যন্ত পৌরসভায় ঘুরেও তার ছেলের জন্ম নিবন্ধনে কোনো কূল-কিনারা খুজে পাননি। পৌরসভা থেকে তাকে বার বার বলা হচ্ছে, সার্ভারের সমস্যার কারণে কিছু করা যাচ্ছে না।

একই কথা জানান ঠনঠনিয়া শহীদ নগর এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান। তিনি জানান, দেড় মাস আগে তিনি আবেদন করে ফরম জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো হদিস পাচ্ছেন না। বললেন, ছেলে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। জন্মনিবন্ধন তো লাগবেই। এরকম সময় যদি জন্মনিবন্ধন নিয়ে এরকম সমস্যা হয় তাহলে আমরা কিভাবে এটার সমাধান করবো? আমরা তো হয়রানি-ভোগান্তির মধ্যে পড়েছি।

সরেজমিনে বগুড়া পৌরসভা ঘুরে জানা গেছে, বাংলাদেশের মধ্যে বৃহত্তর পৌরসভা এটি। আর  এই পৌরসভার জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।  জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য প্রতিদিন  একশ’র বেশি আবেদন জমা পড়ছে। সার্ভার জটিলতার কারণে গত ৬ মাসের বেশি সময় জন্মনিবন্ধনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং সেবাগ্রহিতাদের হয়রানি এবং ভোগান্তি চরমে উঠেছে।  প্রতিদিন জন্ম সনদ নিতে আসা ব্যক্তিদের সাথে জন্ম সনদের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বাকবিতণ্ডা হচ্ছে।  

এদিকে, গত আগস্ট মাসে রেজিস্ট্রোর জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন মো. রাশেদুল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিদিন ৩০টি করে জন্মনিবন্ধন রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর একজন ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করলে সেই সনদ পেতে সময় লাগছে দুই মাসেরও বেশি।

পৌরসভার ভেতরে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের আবেদনের কাজ করেন সাহিত্য রায়। তিনি বলেন, আমরা আগে দিনে ৫০টির বেশি জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারতাম। এখন দিনে ১০টাও করা যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা আবেদনগুলো বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। বাসাতেও অনেক চেষ্টা করে ২০-২৫টি করতে পারছি। এজন্য মানুষ অনেক হয়রানির শিকার হচ্ছে।  

জন্মনিবন্ধন ফি সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি কেউ চায় তাহলে নিজের মোবাইল থেকেই করতে পারে। আর যারা পারে না তাদের কাছ থেকে ৬ টাকা চার্জ নিয়ে আমরা করে দিচ্ছি। পেমেন্টের সার্ভারও দিনে বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। যে কারণে তাদের টাকা নিয়ে যাই। রাতে করে দিই। পরের দিন তাদেরকে আবার দিয়ে দিই।

জন্ম নিবন্ধন কাজে নিয়োজিত পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর আবু সাইদ শাহীন বলেন, সার্ভারের সমস্যার কারণেই গ্রাহকের পাশাপাশি আমাদেরও ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। প্রথম সমস্যা হলো সাইট খুলে ওটিপি দিতেই দেখা যায় ওটিপি আউট। এছাড়া সার্ভার ডাউন হওয়ার কারণে কোন কাজ সঠিকভাবে করাই সম্ভব হয় না। বর্তমানে আমাদের ৩০টি জন্ম সনদ রেজিস্ট্রেশন করার অনুমতি রয়েছে।  সার্ভার ডাউনের কারণে মাত্র ৩০টি সনদ রেজিস্ট্রেশন করতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা-৭টা বেজে যায়।  সার্ভার ঠিক থাকলে এই কটা সনদ করতে খুব বেশি হলে আধা ঘণ্টা সময় লাগতো। এছাড়া মৃত্যু সনদের ক্ষেত্রে আগের যে মৃত্যু সনদ ছিলো সেগুলোর প্রতিলিপি বের করতে গেলে সেখানে লেখা আসছে ‘এই নিবন্ধনের সিকিউরিটি কোড অনুপস্থিত’। কিন্তু আমরা আসলে বুঝতে পারছি না এখানে আসলে কি সিকিউরিটি কোড লাগবে। জন্ম সনদ প্রিন্ট করতে গিয়েও একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অনেকক্ষণ পরপর প্রিন্ট করা যাচ্ছে। কখনও প্রিন্ট হয়, আবার কখনও হয় না।

পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শাহ আলী খান বলেন, ১৫ দিন আগে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল মহোদয়ের সাথে আমাদের মেয়র মহোদয়ের জুম মিটিংয়ে কথা হয়, তিনি আমাদের প্রতিদিন ২০০ টি করে জন্মনিবন্ধন করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এখনও আমরা পাইনি। সার্ভার ডাউনের কারণে এই ৩০টি করে জন্ম সনদ রেজিস্ট্রেশন করাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। পুনঃমুদ্রন-সংশোধিত আমাদের এখানে অনেক আবেদন হয়। কোন আবেদনেরই দ্রুত সেবা দিতে আমরা পারছি না। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের যে আবেদন ফি ৫০ টাকা করে। সেটাও জমা দিতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। হয়তো একটা দুটো আবেদনের টাকা জমা হলো তারপর সারাদিন আর জমা হয় না। আবার রাত ৩-৪টার দিকে জমা হয়, ভোর রাতের দিকে জমা হয়।  প্রতিদিনই মানুষ এরকম নানা অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে।  প্রতিদিনই আমাদের সাথে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে জনগণের সাথে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দিন পার করছি।

পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলম বলেন, প্রায় সকল সেবায় এখন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটা খুব সহজে জনগণের পাওয়া উচিত। জন্ম নিবন্ধনের সার্ভার নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রার জেনারেল মহোদয়ের সাথে কথাও বলেছি। সারাদেশেই রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে ৩০টির বেশি জন্মনিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হচ্ছে না। বগুড়া পৌরসভা বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৃহত্তর পৌরসভা। এখানে প্রায় ১০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে অনেক পৌরসভা রয়েছে যেখানে ৩০ হাজারের মতো জনসংখ্যা। তারাও দিনে ৩০টি জন্ম নিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে, আমরাও একই। এ কারণে এখানকার জনগণ চরম হয়রানি হচ্ছে। আমরাও অস্বস্তিতে পড়েছি। এই বিষয়টা নিয়ে ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রোর জেনারেল মহোদয়কে আমিও বলেছি। মেয়র মহোদয়ও বলেছেন। তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যত দ্রুত সম্ভব এগুলোর সমাধান তিনি করবেন।  

বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকারের বিভাগীয় পরিচালক আছে উনার মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর জানিয়েছি। আমরা লোকাল গভমেন্টও জানিয়েছি যাতে করে জন্মনিবন্ধন নিয়ে সফটওয়্যারগত যে জটিলতা আছে সেটার সমাধান এবং ৩০ জন করে ফিক্সড করে দেওয়ার কারণে মানুষের যে ভোগান্তি সেটিও জানিয়েছি। হয়তো এই সমস্যাগুলো বেশিদিন থাকবে না। তারাও আশ্বস্ত করেছেন যে কিছুদিনের মধ্যেই এটির সমাধান হয়ে যাবে।