রাজধানীর কোলঘেঁষা শিল্পনগরী গাজীপুরের গুরুত্বপূর্ণ আসন গাজীপুর-৪। স্বাধীনতার আগ থেকে এ আসনটি আওয়ামী লীগের নিরাপদ ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মভূমি এই আসনে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ছয় বার জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। আসনটি আওয়ামী লীগের অনেকটা নিরাপদ ও শক্ত ঘাঁটি হলেও দলীয় কোন্দল ও বিভক্তি রয়েছে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আফসার উদ্দীন খান। এরপর ২০০১ ও ২০০৮ সালে এমপি হন তাজউদ্দীনপুত্র আওয়ামী লীগের তানজীম আহমদ সোহেল তাজ। পরবর্তীতে ২০১২ সালে উপ-নির্বাচন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এমপি হন তাজউদ্দীনকন্যা আওয়ামী লীগের সিমিন হোসেন রিমি। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য রিমি এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী। সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবে এলাকায় তার রয়েছে জনপ্রিয়তা।
দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রসঙ্গে রিমি বলেন, ‘আমি আশাবাদী, এবারও দলের মনোনয়ন পাব। আমি জনগণের জন্য কাজ করেছি। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমি তার জন্যই কাজ করব। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
তবে এবারের দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে শুধু রিমি নন। এ আসনে মামাত বোনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভাগ্নে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা শিল্পপতি আলম আহমেদ। এ আসনের সাধারণ ভোটারের কাছে তার পরিচিতি রয়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
আলম আহমদ বলেন, ‘নৌকা যার আমরা তার। আল্লাহ ও আমার পিতা-মাতার পর আমি আমার নেত্রীকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করি এবং নেত্রীর প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। তবে এবারের নির্বাচন হবে অন্যরকম। এ জন্য আমরা দলীয়ভাবে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পেলে নেত্রীর রোডম্যাপ শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারব, ইনশাল্লাহ। আমাকে নৌকা দিলে আমি ৮০ ভাগ ভোট পাব এবং উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর উত্তরপাড়ের ৮টি ইউনিয়নে ৯০ ভাগ ভোট পাব। যে কোনো প্রতিকূলতায় জয় আমারই হবে।’ এছাড়াও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমানত হোসেন খান ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান আরিফ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলেও জানা গেছে।
নেতাকর্মীদের দাবি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যার হাতেই ঐতিহ্যবাহী এই আসনে নৌকার টিকিট আসবে, তাকে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
বিএনপি সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে থাকলেও যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যায়, তবে সেখানে দলটির একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ’র মৃত্যুর পর তার ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান নির্বাচনি মাঠ এগিয়ে রয়েছেন। তাই তিনি দলের কাছে মনোনয়ন চাইবেন।
শাহ রিয়াজুল হান্নান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই আমাদের। সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন হলে তখন আমরা নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তা করব।’
দলের মনোনয়ন নিয়ে গাজীপুর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করব। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের দল শাহ রিয়াজুল হান্নানকে মনোনয়ন দেবে। হান্নানকে মনোনয়ন দিলে এই আসন থেকে বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হবেন। দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে অবশ্যই দলের স্বার্থে ও দলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।’
তিনি আরও বলেন, বিএনপি বিগত দিনে সাধারণ মানুষের কথা বলেছে। তবে এই সরকারকে মানুষ পছন্দ করে না। কারণ, তারা জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মানুষ পরিবর্তন চায়। বিএনপি ক্ষমতা এলে দ্রব্যমূল্যের দাম কমবে। সাধারণ মানুষ স্বস্তি ফিরে পাবে।
বিএনপির অপর নেতা সাখাওয়াত হোসেন সেলিম বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর যাবত দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি অংশ নেবে না। তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি প্রার্থী হব। বিগত দিনে গাজীপুর ও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১১টি মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে এবং দল আমাকে এসব বিবেচনা করে মনোনয়ন দিয়ে মূল্যায়ন করবে বলে আশা করছি।’
এই আসনে নির্বাচন করতে চায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ও। তিনিও খুব তোড়জোড় করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি মাঠেও নেমেছে পড়েছেন।
নির্বাচনে নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ বলেন, ‘আমি মনোনয়নের ক্ষেত্রে শতভাগ আশাবাদী। এলাকার মানুষ পরিবর্তন চায়, এলাকার মানুষ তারুণ্য চায়। যদি জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে আমি বিগত দিনে যেভাবে কাজ করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করব। আমি সংসদ সদস্য হওয়া মানেই আমার এলাকার প্রতিটি মানুষ সংসদ সদস্য।’
এই আসনে মোট ভোটার ২ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৯ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪১৮ জন।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৮২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ছিলেন বিএনপির আব্দুল মজিদ মিনু। তিনি পান ৬৪ হাজার ৪৬৬ ভোট।
এর পর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সিমিন হোসেন রিমি। ওই নির্বাচনে তিনি ১ লাখ ১২ হাজার ৮৮৭ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির এম এম আনোয়ার হোসেন পান ৭ হাজার ৮৩৩ ভোট।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সিমিন হোসেন রিমি। ওই নির্বাচনে তিনি ২ লাখ ৩ হাজার ২৫৮ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহ রিয়াজুল হান্নান পান ১৮ হাজার ৫৮২ ভোট।