রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রই এখন বিস্মৃতির পথে। হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন দর্শন ও চেতনাবোধ। রংপুরের পায়রাবন্দ থেকে আলো ছড়ানো রোকেয়ার আতুঁর ঘরটিই এখন অন্ধকারে।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তৈরি হয়নি রোকেয়া চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্র। শুধুমাত্র দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে বাংলার নারী জাগরণের এই অগ্রপথিককে। এতে ক্ষুব্ধ তার অনুরাগীরা। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোকেয়াকে সংরক্ষণে নেওয়া হয়েছে বড় প্রকল্প।
সরেজমিনে মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ এলাকায় রোকেয়ার জন্মস্থান ঘুরে দেখা গেছে, মহীয়সী নারীর আতুর ঘরটি ইটের স্তুপ আর শ্যাওলায় আবৃত। প্রতিবছর শ্যাওলা পড়া ইট আর দেয়াল ধুয়ে মুছে চুনকাম করে পালিত হয় রোকেয়া দিবস।
এছাড়াও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে রোকেয়ার বসতভিটা রংপুরের পায়রাবন্দে গড়ে উঠেছে রোকেয়া গবেষণা ও স্মৃতিকেন্দ্র কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরোলেও সেটির প্রাণ এখনো সঞ্চার হয়নি। যেন অধরাই থাকছে রোকেয়ার আদর্শ, জীবন দর্শন। মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াতের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িও পড়ে আছে অবহেলায়। উদ্যোগের অভাবে জন্মস্থানে এখনও রুদ্ধ রোকেয়া চর্চা ও গবেষণার দ্বার।
রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘ঊনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী সেই সময় নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত। এই উপমহাদেশে মুসলিম নারীর যে অগ্রগতি তা অর্জনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্মময় জীবন অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সেই পুরোনো ধর্মান্ধতা নতুন করে আবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কারণ এখনও আমরা রোকেয়াকে ধারণ করতে পারিনি। ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে রোকেয়ার নামটিও।’
দুলাল আরও জানান, এখানে একটি লাইব্রেরি থাকলেও তাতে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বই। আর স্মৃতি কেন্দ্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিলো, রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণাগার, রোকেয়ার স্মৃতি সংগ্রহশালা, এই এলাকার দরিদ্র মেয়েদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, এমফিল ডিগ্রির ব্যবস্থা। এর কোনটিই এখানে সচল নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতি কেন্দ্রকে বিকেএমই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়। সেনা সমর্থিত সরকার চলে যাওয়ার পর এটি দখলমুক্ত করে রোকেয়া চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার দাবি থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। এছাড়াও পায়রাবন্দকে দেশের অন্যতম শিক্ষাসংস্কৃতির স্থান করার প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করা বাক্যটি আজও অধরাই রয়ে গেছে।
পায়রাবন্দ সরকারি রোকেয়া স্মৃতি কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল হক বলেন, ‘যে রোকেয়া মুসলিম নারীদের অন্ধকার থেকে শিক্ষায় আলোকিত করেছিলেন সেই মহীয়সী নারীর জন্মস্থান বাড়িটি আজও অবহেলায় পড়ে আছে। শুধুমাত্র দিবসে চলে একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ আর এর বাইরে অন্য সময় থাকে অনাদরে। দিবসে যে টাকা খরচ হয় সেই টাকা হলেই আতুর ঘরটি পূর্বের ঘরের আদলে রূপ দিয়ে সংরক্ষণ করা যেতো কিন্তু বছরের পর বছর সেটি অধরাই থেকে যাচ্ছে। এতে দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদেরও বাড়ছে হতাশা।’
রোকেয়ার দর্শন সমাজের সর্বত্র তুলে ধরাসহ দর্শনার্থীদের জন্য তার স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থানকে আরও আধুনিকায়ন করার দাবিও জানান তিনি।
এদিকে, মহীয়সী এই নারীর স্মৃতি সংরক্ষণের দীর্ঘ আঁধার কাটাতে প্রতিবারের ন্যায় এবারও কার্যকরি উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানালেন রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র পায়রাবন্দের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবিদ করিম। তিনি বলেন, ‘রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটিকে ঢেলে সাজানোর একটি পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় তালিকাভুক্ত রয়েছে। ২০২৩ জুলাই থেকে ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথাও রয়েছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর এর নকশা প্রণয়ন করবে।’
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রকল্প পরিকল্পনায় রয়েছে এখানে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্ত্র করা হবে যাতে প্রধান্য পাবে নারীরা। এছাড়া সংগ্রহশালা, গ্রহন্থাগার, হেলথ সেন্টার, ধাত্রি, হস্তশিল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মুক্তমঞ্চসহ বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।’ রংপুর জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘রোকেয়ার কর্মময় জীবন তুলে ধরতে এবারও ৯ ডিসেম্বর থেকে তার জন্মস্থানে তিনদিন ব্যাপী নানা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা চাই এসব আয়োজনের মধ্যদিয়ে রোকেয়ার দর্শন ও কর্মময় জীবন অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে ধারণা লাভ করূক।’
১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে এক জমিদার পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম। ১৯৩২ সালের এই দিনেই কলকাতায় স্বামীর বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।