নেত্রকোনা জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনেই বইছে নির্বাচনি হাওয়া। জেলা জুড়ে ছেয়ে গেছে প্রার্থীদের পোষ্টার ও ব্যানারে। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডের পাড়া মহল্লার অলিতে-গলিতে প্রচার প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রার্থীসহ তাদের কর্মী সমর্থকরা।
ভোটাররা বলছেন, এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে নেত্রকোনার ১, ২, ৩ ও ৫ আসনে। নেত্রকোনা-৪ আসনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এখানে নির্বাচন হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। আসনটিতে গত ৩১ জুলাই উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়েছিলেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান।
জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়, নেত্রকোনা-১ (দুর্গাপুর-কলমাকান্দা) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোশতাক আহমেদ রুহী (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস আরা ঝুমা (ট্রাক), জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম রব্বানী (লাঙ্গল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী আহমদ শফী (ছড়ি) ও আফতাব উদ্দিন (ঈগল) প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
নেত্রকোনা-১ আসনে নৌকার রুহীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঝুমা তালুকদারের অবস্থান অনেকটাই শক্ত। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। তার বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন তালুকদার এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঝুমা দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। পরে তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এবার এই আসনে ঝুমাসহ মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটারদের ধারণা এই আসনে রুহী ও ঝুমার মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ১৮ হাজার ১৮৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৮ জন ও নারী ২ লাখ ৫ হাজার ১৩৫ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৬ জন।
নেত্রকোনা-২ (সদর-বারহাট্টা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান খসরু (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় (ঈগল), জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোছা. রহিমা আক্তার আসমা সুলতানা (লাঙ্গল), ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী মো. ইলিয়াস (মিনার), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) প্রার্থী এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার (নোঙ্গর), বাংলাদেশ কংগ্রেস প্রার্থী আজহারুল ইসলাম খান (ডাব) ও সুব্রত চন্দ্র সরকার (ট্রাক) প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
নেত্রকোনা-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বর্তমান এমপি ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরু। জেলা সদরের এই আসনটি বরাবরই আওয়মী লীগের দখলে থাকে। কিন্তু এবার এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীকে লড়ছেন সাবেক এমপি, উপমন্ত্রী ও ফুটবলার আরিফ খান জয়। তার বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর খান মিঠু ও ছোট ভাই জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাসুদ খান জনি এবং তাদের মামা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গোলাম মোহাম্মম খান পাঠান। এই আসনে খসরু ও জয়ের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নেত্রকোনা-২ আসনে ভোটার ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৬ জন ভোটার। তাদের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৫৩ জন ও নারী ২ লাখ ৩১ হাজার ৫৪২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ১১ জন।
নেত্রকোনা-৩ (আটপাড়া- কেন্দুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অসীম কুমার উকিল (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী জসীম উদ্দিন ভূঁঞা (লাঙ্গল), ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী মো. এহ্তেশাম সারওয়ার (মিনার), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান খান (সোনালী আশ), স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু (ট্রাক) এবং সাবেক সংসদ সদস্য মঞ্জুর কাদের কোরাইশী (ঈগল) প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। তার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীকে লড়ছেন সাবেক এমপি ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ও ঈগল প্রতীকে লড়ছেন সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশী। এই আসনে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
আসনটিতে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৫ হাজার ২৯২ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১ হাজার ১৪৮ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৮ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটর রয়েছেন ৬ জন।
নেত্রকোনা-৪ (মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাজ্জাদুল হাসান (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. লিয়াকত আলী খান (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. আল মামুন (সোনালী আশ), জাসদের প্রার্থী মো. মুশফিকুর রহমান (মশাল) প্রতীকে লড়বেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান। এই আসনে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু জেলাব্যাপী নানা উন্নয়ণ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় আলোচনায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন সাজ্জাদুল হাসান।
এই আসনটিতে ভোটার ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৬ জন ও নারী ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ ভোটার। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৫ জন।
স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, জয়ের ব্যাপারে অনেকটা নির্ভার হলেও নৌকার এই মাঝি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। হাওর এলাকার উন্নয়নে নৌকার প্রার্থীকেই বিজয়ী হিসেবে দেখতে চান মানুষ।
নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আহমদ হোসেন (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান আজাদ (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আব্দুল ওয়াহ্হাব হামিদি (সোনালী আশ), স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেন (ঈগল) প্রতীকে নির্বাচন করবেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পাঁচবারের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবার মনোনয়ন চাননি। তবে তার বড় ভাই জাসদ নেতা জাহাঙ্গীনরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতস্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এছাড়া আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম সোহেল ফকির উচ্চ আদালত থেকে মনোনয়ন ফিরে পাওয়ায় বেশ চাঙ্গা অবস্থায় আছেন। এখানেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয় খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩৯ হাজার ২৭২ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬০ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ১ জন।
নেত্রকোনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অসিত সরকার সজল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, জেলার পাঁচটি আসনেই নৌকার বিজয় হবে। নেত্রকোনার ৮৬টি ইউনিয়নের সর্বস্তরের ভোটাররা ৭ জানুয়ারি নৌকার প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসুক হয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা নৌকার বিজয় উপহার দেবো।