সারা বাংলা

মহাস্থান হাটে ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম চড়া

উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ সবজির মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাট এখন শীতকালীন সবজিতে টইটম্বুর। এমন অবস্থাতেও কাঙ্ক্ষিত দামে নেমে আসেনি কোনো সবজির দর। হাটে অতীতের বছরগুলোর চেয়ে সব ধরণের সবজির দাম বেশি। গত বছর সবজি দিয়ে এক ট্রাক ভরাতে খরচ পড়তো ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা। সেখানে এবার খরচ পড়ছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এখন প্রতিদিন মহাস্থান হাটে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি টাকা।

সরেজমিন মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) সকালে মহাস্থানহাটে গিয়ে দেখা গেছে, শীতকালীন সবজিতে টইটম্বুর অবস্থা। হাটে শীতকালীন সবজির মধ্যে মুলা এবং ফুলকপির পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া বাঁধাকপিও সারিবদ্ধভাবে হাটের মাঝে মাঝে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে সাদা মুলা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া আলু, বেগুন, পটল, টমেটো, কাঁচা মরিচ, লাউ, সবুজ লাউ, ধনিয়া পাতা, শসা ও খিরাসহ সব ধরনের সবজির সরবরাহ দেখা গেছে।

হাটে সাদা আলু- ৪৫-৫৫ টাকা কেজি, লাল আলু ৬০ টাকা কেজি, পাকরি ৭০ টাকা কেজি, বেগুন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি, ফুল কপি ২২ থেকে ২৬ টাকা কেজি, বরবটি ২৫ টাকা কেজি, করলা ৭০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি, কাঁচা মরিচ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি, মুড়িকাটা নতুন পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি, টমেটো ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি, গাজর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস বাধাকপি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৭ টাকা দরে।

৩০০ বছরের পুরনো এই হাটে বগুড়া জেলার কৃষক ছাড়াও গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁর কৃষকরা সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসেন। কিছু কৃষক হাটে দাঁড়িয়ে তাদের পণ্য বিক্রি করেন। তবে, অধিকাংশ কৃষকের সবজি আড়ৎদার ও ফড়িয়া ব্যাপারিরা কিনে নেন। কেউ কেউ আবার উৎপাদিত সবজি জমিতেই বিক্রি করে দেন। 

শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষক মোস্তফা জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি লাগিয়েছেন। এক ভ্যান কপি নিয়ে এসেছিলেন। আজকে তিনি ফুলকপি বিক্রি করেছেন ১ হাজার টাকা মণে।  হাটে আসার পরপরই তার সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। গত কয়েক দিন আগেও তিনি ফুলকপি বিক্রি করেছেন ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা মণ।

মহাস্থান হাটের আড়ৎদার মো. ইউসুফ আলী বলেন, প্রতি বছরের তুলনায় এবার সবজির দাম অনেক বেশি। সাধারণত আগাম জাতের শীতকালীন সবজি যখন বাজারে নামে তখন সরবরাহ কম থাকায় দাম একটু বেশি থাকে। এবারও তেমনই ছিলো। কিন্তু এখন সবজির ভরা মৌসুম। এ সময় দাম আগাম জাতের সবজির সময়ের চেয়ে পার্থক্য খুব বেশি নেই। এখন যেমন ফুলকপি ১০০০ টাকা মণ পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে। আগাম সবজি নামার সময় দাম ছিল ১৩০০-১৫০০ টাকা। 

তিনি আরও বলেন, আগের বছরগুলোতে এরকম সময় ফুলকপি পাইকারি দাম ছিলো ৩-৪ টাকা কেজি। সেখানে এখন পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজি। বাধাকপির দাম ছিল ৫-৬ টাকা পিস, সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা ১৮ টাকা পিছ। 

ইউসুফ আলী বলেন, ‌‘আমি প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১ ট্রাক সবজি চট্টগ্রাম পাঠাই। কোনো কোনো দিন তিন ট্রাকও পড়ে যায়। এখন এক ট্রাক সবজির দাম পড়ছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। গত বছর এই সবজিই ১ লাখ ৮০ থেকে ২ লাখ টাকার মতো খরচ পড়তো। আমরা প্রতিটি পণ্যে কেজি প্রতি ১-২ টাকা লাভ করি। একটা গাড়িতে ১৪ হাজার কেজি মাল যায়। এক গাড়ি থেকে আমার ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা তো হয় না। লাভ-লসের মধ্য দিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছি। কারণ চট্টগ্রামে তো শুধুমাত্র বগুড়ার মোকাম থেকেই মাল যায় না। অন্য মোকাম থেকেও মাল যায়। হয়তো অন্য মোকামে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কিছুটা কম পেলো। সেক্ষেত্রে তারা কম দিয়ে বিক্রি করলো। সেখানে আমি বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলাম। ফলে আমার লাভ হবে না।’

লিয়াকত আলী নামের এক পাইকার বলেন, তিনি ৩১ বছর ধরে মহাস্থানহাট থেকে পাইকারি দরে সবজি কিনে সিলেট,  মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। মহাস্থানহাট থেকে তিনি প্রতিদিন ১৪-১৫ টন মাল কেনেন। 

এই পাইকার বলেন, মাল কিনে প্রতিদিনই লাভ হবে এমন নয়। তবে কোনো দিন হয়তো ১০ হাজার টাকা লোকসান হলো, পর দিন দেখবেন হয়তো ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।

মহাস্থানহাট ইজারাদারের প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মটু বলেন, সবজির সরবরাহ ভালো। তবে গত বছরের চেয়ে এবার সবজির দাম বেশি। গত বছর এরকম সময় ফুলকপির দাম ছিলো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মণ। আজকের বাজারে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ। গত বছর বেগুন ছিলো ৩০০-৪০০ টাকা মণ বর্তমানে ২০০০ টাকা মণ। গত বছর পেঁয়াজ ছিলো এরকম সময় ৫০০-৬০০ টাকা মণ বর্তমানে ৩০০০ হাজার টাকার উপরে। কদু ছিলো প্রতি পিস ৭-৮টা এখন কদু বিক্রি হচ্ছে ২২-৩০ টাকা। প্রতিটা সবজির ক্ষেত্রেই এরকম। মহাস্থানে ৪০টির মতো আড়ৎদার রয়েছেন। প্রতিটি আড়ৎ থেকে ১টি করে ট্রাক হলেও ৪০ ট্রাক সবজি বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। সেখানে গড়ে ৬০ ট্রাক সবজি বগুড়ার বাইরে যাচ্ছে বলা যায়। এতে দিনে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি টাকার।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মতলুবর রহমান বলেন, বগুড়ায় এবার শীতকালীন শাক-সবজির যথেষ্ঠ ভালো উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। বাজারে প্রচুর সরবরাহ আছে। বগুড়ার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অন্যান্য জেলারও চাহিদা মেটানো হচ্ছে এখানকার সবজি দিয়ে।

তিনি আরও বলেন, জেলায় এবার সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। এখন পর্যন্ত চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৪১ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ১৮ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন, সেখানে এখন পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৮ মেট্রিক টন সবজি। আগামী এপ্রিল পর্যন্ত জমি থেকে ফসল উত্তোলন করা যাবে। এতে করে আমাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করি।