দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোরের ৬টি আসনের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই হেভিওয়েট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এবং শাহীন চাকলাদারকে পরাজিত করে ওই দুটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। স্বপন ভট্টাচার্য এবং শাহীন চাকলাদারের পরাজয় স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভোটের ফল নিয়ে চলছে নানান সমীকরণ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম ইয়াকুব আলীর কাছে ৫ হাজার ১৩৬ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট। বিপরীতে ঈগল প্রতীকে ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি ইয়াকুব আলী।
দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বপন ভট্টাচার্যর পরাজয়ের পেছনে তিনটি কারণ প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হলো নিয়োগ ও ঘুষ-বাণিজ্য, ছেলে-ভাগ্নের নেতৃত্বাধীন কথিত সিন্ডিকেট এবং দলের ভেতর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
স্বপন ভট্টাচার্য ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, সে সময় তার ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন ছিল। ফলে দ্রুত জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যান। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং জয়ী হন।এ জন্য তাকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। ২০১৭ সালে স্বপন ভট্টাচার্যের বরখাস্তের আদেশ দল প্রত্যাহার করে নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন। এবার তিনি মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পান।
দলের নেতাকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি-অনিয়ম এবং দলের নিবেদিত প্রাণদের ওপর নিপীড়নের কারণে মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ স্বপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছিলেন না। তার ভাগ্নে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুর বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। ভবদহ অঞ্চলের নদী খননে তার ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য শুভর কাজ পাওয়া এবং সেই কাজে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপারে সংসদ সদস্যের অবস্থান নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন আলোচনা। এই আসনে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা বেশি। অথচ মন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া নিয়ে স্বপন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে।
এসব বিষয়কেই তার পরাজয়ের কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা জানান, মূলত প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তার জনপ্রিয়তায় ভাটা নামে।
মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিকাইল হোসেন বলেন, অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য স্বপন ভট্টাচার্য প্রতি ইউনিয়নে অযোগ্য ও সুযোগসন্ধানী লোকদের পুষেছেন।
স্বপন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে দলের ভেতর বলয় সৃষ্টির অভিযোগ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ‘দলের কর্তৃত্ব নিতে তিনি ত্যাগী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করিয়েছেন। তার ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য শুভ এবং ভাগ্নে উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুর নেতৃত্বে প্রতি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে অপকর্মের সিন্ডিকেট। এদের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বজায় রেখেছেন। এসব অপকর্মের কারণে দলের কর্মী-সমর্থক ছাড়াও সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ফলে সবাই এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
তবে স্বপন ভট্টাচার্যর অনুসারী হিসাবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ কাজী মাহমুদুল হাসান বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ রেষারেষির কারণে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
শাহীন চাকলাদার
অন্যদিকে যশোর -৬ (কেশবপুর) আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তিনি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ৩৯ হাজার ২৬৯ ভোট পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলাম ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৯৪৭ ভোট।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে হাতুড়ি বাহিনীর কাছে কেশবপুর উপজেলা জিম্মি হয়ে ছিল। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যদের হাতে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের বেপরোয়া আচরণের হাত থেকে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও রেহাই পায়নি। তবে যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে শাহীন চাকলাদার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় কেশবপুরের চিত্র পাল্টে যায়। হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যায়। ঐক্যবদ্ধ হয় তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে হাতুড়ি বাহিনী না থাকলেও শাহীন চাকলাদারের অনুসারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। স্বজনপ্রীতি, বিভিন্ন স্থানে নিয়োগের নামে বিএনপি নেতাকর্মীদের পুর্নবাসন, অনিয়ম ও দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শাহীন চাকলাদারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে এক সময়ের ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ এখন দল, উপদলে বিভক্ত। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার পরাজয়ের মাধ্যমে।
শাহীনের বিরোধী শক্তিরা তাকে হটাতে নির্বাচনি মাঠে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন বলেও জানান দলের অনেক কর্মী। তারা ‘স্থানীয় এমপি চাই’ স্লোগান দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেছেন। উল্লেখ্য শাহীন চাকলাদার কেশবপুরের সংসদ সদস্য হলেও তার বাড়ি যশোর সদরে।
স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৯ বছর বয়সী আজিজুল ইসলাম এলাকার তরুণদের কাছে জনপ্রিয়। তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় থেকে জনসংযোগ করছেন। তার জয়ে তরুণ ভোটারদের অবদানই বেশি। ‘স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেব’ এমন জোয়ার তাকে জয়ী করেছে বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।
ফল বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাইলে শাহীন চাকলাদারের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আবদুস সামাদ বলেন, ‘শাহীন অনেক ভোট পেয়েছেন। তবে বিএনপি-জামায়াতের একটি অংশের ভোট পাওয়ায় আজিজুল ইসলাম জয় পেয়েছেন। প্রশাসন থেকেও নৌকার কর্মীদের ওপর অতিরিক্ত খবরদারি করা হয়। ফলে নেতাকর্মীরা শাহীনের পক্ষে সহজে প্রচারণা চালাতে পারেননি। এটাও ফল খারাপ হওয়ার একটা কারণ।’
তবে আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেশবপুরের মানুষদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে শাহীন চাকলাদার এবং তার লোকজন নানাভাবে বঞ্চিত করেছেন। সেই বঞ্চিত মানুষই ভোটের মাধ্যমে তাদের রায় দিয়েছেন।’