সারা বাংলা

স্থানীয় আ.লীগে বিভক্তি নৌকা ভাসতে দিলো না!

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জের ৫টি সংসদীয় আসনের চারটিতেই নৌকা জয় পেয়েছে। কিন্তু, সুনামগঞ্জ-২ আসন অনেক আলোচনায় থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচির ‘আঘাতে’ সরকারদলীয় প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের নৌকা ‘ডুবে গেছে’। দিরাই-শাল্লা উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে আ.লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক রেলমন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-২ আসনে স্থানীয় আ.লীগের দুই ভাগে বিভক্তিতে ‘নৌকা ভাসেনি’। কারণ, আ.লীগের ভোটাররাই নৌকায় ভোট দেয়নি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কাঁচি প্রতীক নিয়ে জয়া সেনগুপ্তা পেয়েছেন ৬৭ হাজার ৭৭৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৬৭২ ভোট। ভোটের ব্যবধান ৯ হাজার ১০৩।

নৌকার প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ পরাজিত হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে জানা যায়, সুনামগঞ্জ-২ আসনে ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ন্যাপ থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশের রাজনীতিতে ইতিহাস তৈরি করেন। পরে আওয়ামী লীগ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এমপি নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মৃত্যুবরণ করলে ওই বছরের ৩০ মার্চ উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন সুরঞ্জিতের স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্তা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই আসনে আ.লীগের প্রার্থী হয়ে ড. জয়া নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনিই দিরাই-শাল্লা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ফলে, এ আসনে সেন পরিবারের নিজস্ব ভোটব্যাংক ছিলো বলে জানান তার সমর্থকরা।

উল্লেখ্য, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছোট ভাই। তিনি শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। নৌকার মনোনয়ন পেয়ে পদত্যাগ করে প্রার্থী হন। এ ছাড়া, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের বাবা ছিলেন শাল্লা উপজেলা আ.লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুস সাত্তার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ যখন থেকে উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তখন থেকে তিনি একেকভাবে দলকে চালাতেন। দলীয়ভাবে কোনও কাজ তিনি করেননি। দলের যে অরিজিনাল লোকগুলো ছিল, তা বিভক্ত হয়ে গেয়েছিল। তিনি তার স্টাইলে চলতেন। সাংগঠনিক নিয়ম অনুসারে তিনি চলতেন না। এজন্য দলীয় লোকগুলোও উনার কাছ থেকে সরে গেছেন’।

তিনি আরও বলেন, ‘চৌধুরী সাব যখন শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি আমাদের আ.লীগ দলটাকে সাজাতে পারলেন না। এত বছরেও জনমত সৃষ্টি করতে পারলেন না। সেখানে জনগণ উনাকে নেতা কীভাবে করবে? সংগঠনবিহীন কেউ কোনদিন নেতা হতে পারে না’। 

তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘উনার চারপাশে এতদিন যাদের দেখেছেন, তাদের বেশিরভাগ বিএনপির লোকজন ছিল। তারা আমাদের দলের লোক না। এ ছাড়া, তিনি একদম যুবক বয়সের ছেলেদের নিয়ে চলাফেরা করতেন’। 

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে এ নেতা আরও বলেন, ‘জনমত না থাকলে আইজিপির ভাই কেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাই হলেও নির্বাচনে পাস করতে পারবেন না। রাজনীতি এমন একটা জিনিস, নেতারা যদি জনবান্ধব না হন, তাহলে ভোটে নেতা হতে পারবেন না। তবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের যে সুযোগ ছিল, তার ভাই আইজিপি খুবই ভালো মানুষ। এই সুযোগটা তিনি কাজে লাগাতে পারছেন না। তিনি এমপি সিওর হতেন। কেউ তার জয় ফেরাতে পারতেন না, যদি আমাদের (আ.লীগ) লোকদের নিয়ে চলাচল করতেন’। 

স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, ‘আমাদের আসনে আইজিপির ভাই নৌকা প্রতীক পেয়েছে নির্বাচন করছিলেন। পাশাপাশি আরেকজন ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী ড. জয়া সেনগুপ্তা, তিনি জাতীয় নেতার সহধর্মিণী- এই হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। তিনি দু-দুবারের এমপি। আমি মনে করি, সরকার কোনও পলিসি মেনটেইন করেছে। নয়তো অতীতে দিরাই-শাল্লা নৌকা-ই পাস করেছে’।

শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ২নং হবিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান সুবল চন্দ্র দাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এবার ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এখানে যে বেশি ভোট পেয়েছেন, তিনিই পাস করেছেন। দেশে আরও অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। তবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ খুবই হাড্ডাহাড্ডি অবস্থায় ছিলেন। সামান্য ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হয়েছেন। জয়া সেনগুপ্তা হলেন আ.লীগের, এদিকে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদও একই দলের। সে হিসেবে আ.লীগের মধ্যে দুইটা ভাগ হয়ে গেছে। আর এই দুই ভাগের কারণে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করা যায়নি। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিধান চন্দ্র চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে শাল্লা উপজেলা দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত। এলাকার যোগাযোগ অবস্থা ভালো না। যেখানে ২০ দিলে হতো, সেখানে ৩০০ টাকা লাগে দিরাই যাতায়াত করতে। যে কারণে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানালে শাল্লা উপজেলায় নৌকার মাঝি করে পাঠান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে। কিন্তু আমাদের আ.লীগের মধ্যে দুই ভাগের কারণে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। আর দিরাই উপজেলার কোনও কোনও জায়গায় প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে শুনেছি। আমাদের অনেক ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি’।