সারা বাংলা

পাহাড়ে কমে যাচ্ছে জুমচাষ, হচ্ছে ফলের বাগান

পাহাড় কন্যা খ্যাত বান্দরবানে বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্র। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যা। বাড়ছে জনসংখ্যাও। ফলে কমে যাচ্ছে আবাদি ও জুমচাষের পাহাড়ি জমি। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভের কারণে পাহাড়ের কৃষকরা জুমের পরিবর্তে ফল বাগানের দিকে ঝুঁকছেন বেশি।   

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ৫ বছর বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ৪ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফলের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের আশপাশের ৮-১০টি পাড়ার জুম চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই পাহাড়ে প্রতিবছর জুমচাষ করতে পারেন না তারা। জুমচাষ করতে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে হয় তাদের। এই ফসল উৎপাদনে জমির পরিমাণও প্রয়োজন হয় বেশি। নানাভাবে জমি সংকটের কারণে বর্তমানে একই পাহাড়ে প্রতিবছর জুমচাষ করায় ফসলটির ফলনও তেমন ভালো হচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় জুমচাষের আবাদি জমিও কমে গেছে। পাহাড়ে বর্তমানে জুমচাষের তুলনায় ফলের বাগান করলে অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে। এসব কারণে পাহাড়ে জুমচাষের পরিবর্তে নানা জাতের ফলের বাগানের প্রতি ঝুঁকছেন তারা। 

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক এলাকার পাশে বসন্ত পাড়া। এ পাড়ায় ‘ম্রো’ সম্প্রদায়ের ৩০ পরিবারের বাস। তাদের দাবি, পাড়াটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। এই পাড়ার বাসিন্দাদের অধিকাংশ পরিবার ১০-১৫ বছর আগেও জুমচাষ করতেন। বর্তমানে পাড়ার সবাই বিভিন্ন ফলের চাষ করছেন।

বসন্ত পাড়ার বাসিন্দা তোয়ো ম্রো (৫৫) জুমচাষ ছেড়ে ফলের বাগান করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। প্রায় ২৫ একর জায়গা জুড়ে তার বিভিন্ন ফলের বাগান রয়েছে। 

তোয়ো ম্রো জানান, তার বাগানে রয়েছে ড্রাগন ফলের গাছ। এছাড়া রয়েছে আম রুপালি, বারি ১১, নারকেল, ডক মাই, ব্রুনাই, ব্যানানা, রেড কইন, চেৎমাই, ব্ল্যাক স্টোর জাতের আমের গাছ। বরইয়ের মধ্যে বল সুন্দরী, কাশ্মিরি, আপেল কুল, সিড লেজ কুলের গাছ রয়েছে। মাল্টার মধ্যে রয়েছে মোড়া মাল্টা, বাম্বুটান, ভেড়া কাটা মাল্টা, ভিয়েতনাম মাল্টার গাছ। এছাড়াও, রয়েছে পেঁপে, সজিনা, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। ফল বিক্রি করে বাগান থেকে তিনি বছরে ২০-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। 

তোয়ো ম্রো জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সবাই জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বর্তমানে পাহাড়ি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার কারণে বিকল্প চাষাবাদ হিসেবে ফলের বাগান শুরু করেছিলেন। পরে বুঝতে পারেন জুমচাষের তুলনায় ফল বিক্রি বেশি লাভজনক। ফল বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়েছেন তিনি। তাকে দেখে তার পাড়ার সবাই বর্তমানে ফলের বাগান করছেন।

তোয়ো ম্রো’র ছেলে ক্রংপং ম্রো বলেন, তাদের পাড়ার বেশিরভাগ পরিবার ১০-১৫ বছর আগেও জুমচাষ করতেন। বর্তমানে সবাই ফলের বাগান করছেন। বিভিন্ন ফলের বাগান করলে বছরজুড়ে থাকে কর্মব্যস্ততা। ফল ব্যাপারীদের সঙ্গে থাকে আর্থিক লেনদেন। বছরের প্রথমে থাকে শেষ পর্যন্ত বরই, সজিনা, লিচু, আম, ড্রাগন ও মাল্টা উৎপাদন ও বিক্রিতে কর্মব্যস্ত থাকেন তারা।

একই পাড়ার রইতং ম্রো (৩৪) পাঁচ বছর আগেও জুমচাষ করতেন। ওই সময় সংসার ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। বর্তমানে পাঁচ একর পাহাড়ি জমিতে তার ৫০০ আম গাছ রয়েছে। এই আম বাগান থেকে বছরে ২-৩ লাখ টাকার মতো আয় করেন তিনি। এই টাকায় সংসার ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ ভালোভাবে চালাতে পারছেন বলে জানান রাইতং ম্রো।

বসন্ত পাড়ার মতো চিম্বুক এলাকার নোয়া পাড়া, বাগান পাড়া, ম্রোলং পাড়া, ক্রামাদি পাড়া, সাতং পাড়া, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, রাংলাই চেয়ারম্যান পাড়া ও রামরি পাড়ার বাসিন্দারা সবাই এখন ফলের বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। 

দেওয়াই হেডম্যান পাড়ার তংচং ম্রো গতবছর আম, বরই ও ড্রাগন ফল বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা আয় করেছেন। তিনি বলেন, আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে পাহাড়ি মাটি কোন ফলের জন্য বেশি  উপযোগী তা বুঝা যায়। এরপর বাগান করলে জুমচাষের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়।

বান্দরবান-থানচি রাস্তার চিম্বুক পাহাড় এলাকার রামরি পাড়ার ইয়াংঙান ম্রো। ‘ম্রো’ ভাষা গবেষক ও লেখক তিনি। প্রথম ‘ম্রো’ ভাষার অভিধান লেখকও তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি আট বছর ধরে ছয় একর পাহাড়ে ড্রাগন ফল, আম, বরই, জাম্বুরা ও লেবুর বাগান করছেন তিনি। গতবছর বাগান থেকে ইয়াংঙান ম্রো দুই লাখ টাকার মতো আয় করেছেন। 

ইয়াংঙান ম্রো বলেন, পাহাড়িরা শত শত বছর ধরে জুমচাষ করছেন। আগে একেক বছর একেক পাহাড়ে জুমচাষ করতেন তারা। বর্তমানে পাহাড়ি জমি পর্যাপ্ত না থাকায় প্রতি বছর একই পাহাড়ে জুমচাষ করতে হচ্ছে। এই কারণে ফলনও ভালো পাওয়া যায় না। জুমচাষে পরিশ্রমও তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে ফলের বাগান প্রথম বছর যথাযথ পরিচর্যা করলে পরবর্তী বছর থেকে ফলন পাওয়া যায়। বছর বছর ফলন বাড়তে থাকে। জুমচাষের চেয়ে ফলের বাগান লাভজনক। 

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এম এম শাহ নেয়াজ বলেন, পাহাড়ে জুমচাষ করতে জমিতে আগুন দেওয়া লাগে। আগুন দেওয়ার কারণে পরিবেশের ক্ষতি হয় ও মাটির অনেক অর্গানিক উপাদান নষ্ট হয়ে। ফলে মাটির উর্বরতাও কমে যায়। জুমচাষ যেহেতু ‘স্থান পরিবর্তনশীল কৃষিকার্য’ তিন-চার বছর পরপর এক একটা পাহাড়ে জুমচাষ করা হয়। বর্তমানে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও খাদ্য চাহিদার চাপে পাহাড়ের কৃষকরা তিন-চার বছর অপেক্ষা করতে পারছেন না। দেখা যায় একই পাহাড়ে প্রতিবছর জুমচাষ করায় ফলন তেমন ভালো হয় না।

তিনি আরো বলেন, বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড় রেঞ্জ, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি দুর্গম পাহাড়ি এলাকার কৃষকরা জুমচাষ কমিয়ে দিয়ে ফল বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষি বিভাগ এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে কৃষকদের সহযোগিতাও করা হচ্ছে।