সারা বাংলা

জিআই স্বীকৃতি মিললেও সঙ্কটে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা 

জিআই স্বীকৃতি পাওয়া কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শত বছরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে, নানা প্রতিবন্ধকতায় এই ক্ষুদ্র শিল্পটি বর্তমানে রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা নতুন করে এই শিল্পকে নিয়ে আশার আলো দেখছেন। তার দাবি, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এই শিল্পের সুদিন ফেরানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সঙ্কট নিরসনের ব্যবস্থা করা।

কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেনি বা খাননি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া মুশকিল। দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় অনেক আগে থেকেই  কুষ্টিয়ার তিলের খাজা স্থান করে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দারুণভাবে এগিয়ে স্বল্পমূল্যের এই স্থানীয় খাবারটি। একটা সময় কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলাতে এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কয়েকশ’ পরিবারের সদস্য। হাতে তৈরি খেতে দারুণ সুস্বাদু কুষ্টিয়ার এ তিলের খাজা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন ও লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব জায়গায় ক্রেতা আকৃষ্ট করতে খুব বেশি হাঁকডাকের প্রয়োজন না পড়ায় বুঝে নিতে হয় এই খাজার ইতিহাস খুবই ‘সমৃদ্ধ’। দেশের অন্য অঞ্চলেও কুষ্টিয়ার তিলের খাজা'র উপস্থিতি মেলে। শত বছরের এই খাদ্যপণ্যটি এখন ক্ষুদ্র শিল্পে রূপ নিয়েছে। কুষ্টিয়ার মাটি ছাড়িয়ে এটি এখন অন্যান্য জেলাতেও তৈরি হচ্ছে।

ঠিক কবে থেকে এই তিলের খাজার উৎপাদন শুরু এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ইতিহাস অনুসারে অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া শহরে বেকারি পণ্যের জন্য পরিচিত দেশওয়ালী পাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাল সম্প্রদায়ের মানুষ এই খাবার তৈরি করতেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে ‘তেলি’ সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে এই খাবারটি প্রথম কুষ্টিয়াতে তৈরি হয়। কুষ্টিয়ার এক খামারে কাজ করাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘তেলি’ সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে এখানে আনে। কৃষিপণ্য তিল থেকে তেল নিঃসরণের কাজ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে এই মিষ্টান্নের উদ্ভাবক ‘তেলি’ সম্প্রদায় বলে ধারণা করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে ‘তেলি’ সম্প্রদায়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, সেই এলাকায় কয়েকটি পরিবারকে তিলের খাজা তৈরি করতে দেখা যায়। ১৯৭০ এর দশকেই কুষ্টিয়া শহরের চর মিলপাড়ায় কয়েকটি খাজা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর থেকেই কুষ্টিয়ায় ধীরে ধীরে তিলের খাজার প্রসার ঘটতে থাকে। ক্রমেই ‘কুষ্টিয়ার তিলের খাজা’র সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও।

সাধারণত কুষ্টিয়া জেলায় তিন ধরনের তিলের খাজা তৈরি হয়ে থাকে। তিল ভেদে প্রকার নির্ণয় করা হয়। তিলের খাজা তৈরির প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি। চুলায় চাপানো বড় লোহার কড়াইয়ের মধ্যে চিনি দিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সিরা। নির্দিষ্ট তাপে আসার পর নামানো হয় চুলা থেকে। হালকা ঠান্ডা হলে চিনির সিরা জমাট বেধে যায়। তখন শিংয়ের মত দো-ডালা গাছের সঙ্গে হাতে টানা হয় জমাট বাধা চিনির সিরা। এক পর্যায়ে বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলে কারিগর বিশেষ কায়দায় হাতের ভাঁজে ভাঁজে টানতে থাকেন। তখন এর ভেতরে ফাঁপা আকৃতির হয়। সিরা টানা শেষ হলে রাখা হয় পরিস্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় তিলের খাজা। পরে এগুলো প্যাকেটজাত করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

কারিগররা জানান, আরও এক ধরনের তিলের খাজা তারা তৈরি করেন। তাতে দুধের ছানা মেশানো হয়। এর উপকরণ ছানা, চিনি ও তিল। কারখানায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ‘তিলের খাজা’ তৈরি হয়। চিনি ও দুধ স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হলেও তিল কেনা হয় চট্রগ্রাম, সিলেট, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে। ভালোমানের তিল পাহাড়ি অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করা হয়।সাধারণ তিলের খাজা ১৮০ ও স্পেশাল তিলের খাজা ৩৫০ টাকা কেজি এবং এর এক প্যাকেট ২০ টাকায় বিক্রি হয়।

তিলের খাজা তৈরির কারাখানার মালিক সাধারণত সেখানকার শ্রমিকরাই। এটি পরিচালিত হয় অংশীদারী ব্যবসা হিসেবে। প্রতিটি কারখানায় মালিক-শ্রমিক মিলে ৩০ থেকে ৫০ জন থাকেন। তারা যৌথভাবে বিনিয়োগ করেন। তবে, এই বাইরে নিজস্ব মালিকানার কারাখানাও রয়েছে। মালিক ও কারিগরদের অভিযোগ, কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। অন্য জেলায় তৈরি হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন।

কথা বলে জানা গেছে, সারা বছরই তৈরি করা হয় তিলের খাজা। তবে শীত মৌসুমে এর আলাদা কদর রয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে বাড়তি লোকের কর্মসংস্থান। এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা সৃষ্টি করা হলে এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু, সেই সুবিধা না থাকার কারণে সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রসার ঘটছে না এই ক্ষুদ্র শিল্পের। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তিলের খাজা শিল্প।

কুষ্টিয়াতে বর্তমানে দুটি তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। এর মধ্যে জয়নাবাদ এলাকায় একটি এবং অপরটির অবস্থান মিলপাড়াতে। জয়নাবাদে সবচেয়ে নামকরা ‘১ নং নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা’। কথা হয় কারখানা মালিকের ছেলে আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেটা আমরা জেনেছি। কিন্তু, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটছে না। বর্তমানে মাত্র দুইটি তিলের খাজা কারাখানা চালু রয়েছে। আমাদের কারখানায় কারিগর কাজ করে ২৬ জন। একটা সময় চাহিদা ভেদে কারখানায় কয়েক শ’ কারিগর কাজ করতেন। তার মতে সার্বিক সহায়তা পেলে এ শিল্পকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব। 

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা বলেন, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াটা আমাদের জন্য গৌরবের। এই পণ্যের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। ক্ষুদ্র এই শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে স্বাস্থ্যগত মানটা ঠিক রাখতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, ঋণের ব্যবস্থার জন্যও জেলা প্রশাসন কাজ করবে।

প্রসঙ্গত, দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। দেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি শাড়ি। এরপর একে একে জিআই পণ্য হিসেবে গত ১০ বছরে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। বিদায়ী বছরের জুন মাসে শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম এবং নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়। নতুন জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যগুলো হলো কুমিল্লার রসমলাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং বাংলাদেশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল।