একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রথম আত্মপরিচয় হয় মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে। মাতৃভাষা টিকে থাকা মানেই একটি জাতি ও জাতিগোষ্ঠীর টিকে থাকা। বাংলাদেশে বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী বাংলা ভাষাভাষী। বাঙালির পাশাপাশি চাকমা, মারমা, সাওঁতাল, গারো, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খুমি খেয়াংসহ ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, এই ৫০টি স্বীকৃত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে ৪১টি নৃ-তাত্বিক গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে।
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতির তালিকায় নাম না থাকলেও বান্দরবান আলীকদম দুর্গম পাহাড়ে একটি নৃ-তাত্ত্বিক জাতি হল ‘রেংমিটচ্য’। এই ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা এখন মহাবিপন্ন। এই ভাষায় কথা বলতে বা মনেরভাব প্রকাশ করতে পারেন মাত্র ছয়জন মানুষ। তারা সবাই ষাটোর্ধ্ব। এই ছয় জন মারা গেলেই বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে 'রেংমিটচ্য' ভাষা।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ১১৯ কিলোমিটার দূরে আলীকদম উপজেলা। সেখান থেকে তৈন খাল হয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকা যোগে দেড় ঘণ্টা উজানে গিয়ে রাণীর ঘাট।এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় তৈনফা মৌজার দুর্গম পাহাড়ের ক্রাংসি পাড়ায়। এই পাড়ায় 'রেংমিটচ্য' ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। এই পাড়ায় মোট ২৮ পরিবারের মধ্যে এখনও রেংমিটচ্য ভাষার ৭টি পরিবার রয়েছে। কিন্তু, চার জন ব্যক্তি ছাড়া, নতুন প্রজন্মের কেউই এ ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন ম্রো জনগোষ্ঠীর হলেও তারা রেংমিটচ্য ও ম্রো ভাষায় কথা বলে থাকেন। তবে, ম্রোদের মধ্যে শুধু রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র ছয়জন। তারা হলেন- আলীকদম সদর উপজেলার নয়াপাড়া ইউনিয়নের ক্রাংচি পাড়ার বাসিন্দা মাংপু ম্রো (৭৮), কুনরাও ম্রো (৭২), কুনরাও ম্রো (৬২) এবং নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)। অন্য দু'জন হলেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াই বট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুং ম্রো (৭২) ও সাংপ্লং পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৫)। এদের মধ্যে মাংপুং ম্রো, রেংপুং ম্রো ও মাওয়াই ম্রো আপন ভাই।
চিংরা ম্রো'র বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা শিখতে আসা শিশুরা
ক্রাংসি পাড়ার রেংমিটচ্য ভাষা জানা মাংপু ম্রো বলেন, ‘রানী পাড়া, সাংথং পাড়া, কিউকি পাড়া এবং বোন চু পাড়ার সবাই রেংমিৎচা ভাষা জানতেন। একেকটি পাড়াতে ৬০-৮০টি পরিবার ছিল। তারা শুধু রেংমিৎচা ভাষা জানতো অন্য কোন ভাষা জানতো না। ৬০-৭০ বছর আগে ওইসব পাড়ায় কলেরা ও ডায়রিয়া মহামারি আকার ধারণ করলে কিছু কিছু পরিবার মিয়ানমার বা ভারতে চলে যায়। বাকি পরিবারগুলো ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। এভাবেই দিন দিন রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন কমে গিয়ে চর্চার অভাবে ভাষাটিও হারাতে বসেছে।’
২০১৪ সালে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে করা বাংলাদেশ নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৪টি ভাষা বিপন্ন তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপন্ন ভাষার মধ্যে 'রেংমিটচ্য' ভাষা একটি।
রেংমিটচ্য ভাষা জানা মাংপু ম্রো’র দুই ছেলে চিংরা ম্রো এবং মেনরুম ম্রো। মেনরুম ম্রো বাবার ভাষা বোঝেন কিন্ত, বলতে পারেন না। তবে, চিংরা ম্রো তার মাতৃভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন।
রেংমিটচ্য ভাষা জানা মাংপু ম্রো বলেন, ‘আমি মরে গেলে আমাদের ভাষাও মারা যাবে। তাই আমি আমার ছেলে চিংরাকে রেংমিটচ্য ভাষা শিখিয়েছি।’
ক্রাংসি পাড়ার ‘রেংমিটচ্য’ ভাষাভাষীর মানুষ
রেংমিটচ্য ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চিংরা ম্রো ও ইয়াংঙান ম্রো তাদের নিজেদের উদ্যোগে গত ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় শিশুদের মধ্যে এই ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছেন। সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই রেংমিটচ্য ভাষা এদেশের ভূখণ্ড থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে বলে ধারণা তাদের। রেংমিটচ্য ভাষা বাঁচিয় রাখার উদ্দেশ্যে চিংরা ম্রো ক্রাংসি পাড়ায় নিজ বাড়িতে ৩৫জন নতুন প্রজন্মের শিশুকে এই ভাষার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার উদ্যোক্তা ও ম্রো ভাষার লেখক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, ‘শিশু-কিশোর মিলে ৩৫ জন রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। শুরুতে ২১ জন ছিল। এখন ৩৫ জন শিক্ষার্থী আছে।’
রেংমিটচ্য ভাষার শিক্ষক চিংরা ম্রো বলেন, ‘আমার বাবা রেংমিটচ্যভাষী হলেও এই ভাষা আমি পুরোপুরি পারি না। যতটুকু বলতে পারি বাবা থেকে শিখেছি। বাবা এখনও রেংমিচ্য ভাষা বলতে পারেন। আমি যতটুকু জানি ততটুকু আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেখাচ্ছি। আপাতত ৩৫ জনকে এই ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বয়স্করা মারা গেলেও যাতে মুখে হলেও অন্তত এই ভাষাটি বেঁচে থাকে সেই চেষ্টায় করছি।’
আদিবাসী ভাষা প্রযুক্তি কর্মী সমর সরেন বলেন, বাংলাদেশে ১৪টি ভাষা বিপন্নর তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপন্ন ভাষার মধ্যে 'রেংমিটচ্য' ভাষা একটি। রেংমিটচ্য ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীই নয় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও এই ভাষা চর্চা করা প্রয়োজন। এতে ভাষাটির পরিধি বৃদ্ধি পাবে।