পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা মোকাবিলা করে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সেবা দিয়ে অনবদ্য স্বাক্ষর রেখে চলেছেন খুলনার পাখি দত্ত। তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফেরাতে কাজ করছেন তিনি। ইতোমধ্যেই কাজের সফলতাও পেয়েছেন। শুক্রবার (৮ মার্চ) বিশ্ব নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর আগে, খুলনা জেলা ও বিভাগের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জয়িতা অন্বেষণের আওতায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কারও পান তিনি।
জানা গেছে, আবহমান কাল থেকে অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়। পরিবার ও সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এই জনগোষ্ঠী। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর একজন (হিজড়া) হয়েও সমাজের সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দৃঢ়তার সঙ্গে মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নজির গড়েছেন হিজড়া পাখি দত্ত। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গড়ে তুলেছেন স্বতন্ত্র সংগঠন। সমাজের মূল স্রোতধারায় যাতে এই জনগোষ্ঠীর লোকরা সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন সেই উদ্যেগ নিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: পাখি’র জয়ীতা পুরস্কার পথ দেখাচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে
পাখি দত্ত জানান, ১৯৯২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনার সোনাডাঙ্গায় জন্ম তার। বাবা মঙ্গল চন্দ্র দত্ত ও মা রিনী রানী দত্তের নিম্নবিত্ত পরিবারে পাখি দত্তের জন্ম ছিল আলোকবর্তিকার মতো। বাবা মঙ্গল চন্দ্র দত্ত ছিলেন স্বল্প বেতনের নিম্নপদস্থ কর্মচারী। শৈশব থেকে দরিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। বাবা-মায়ের আদর-স্নেহে সেই অভাব তিনি খুব একটা বুঝতে পারেননি। তিনি যথারীতি শৈশব থেকে কৈশরে পদার্পণ করেন। স্বাভাবিক মানুষের মতো তার শারীরিক পরিবর্তন না ঘটায় ক্রমান্বয়ে পরিবার, স্কুল ও সামাজিক জীবনে নানাবিধ নির্যাতন-হয়রানির শিকার হন। যার একমাত্র কারণ ছিলো লিঙ্গ পরিচয়। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনে তার মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। একই বয়সের অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করতে পারতেন না তিনি। বাড়ির আশপাশের লোকজন ও সহপাঠীরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো।
ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের নিয়ে আয়োজিত কর্মশালায় বক্তব্য দিচ্ছেন পাখি দত্ত
এক সময় সমাজের লোকজন তার পরিচয় দেয় ‘হিজড়া’ হিসেবে। যার প্রভাব পড়ে তার পরিবারেও। ২০০৬ সালে মাত্র সাড়ে ১৩ বছর বয়সে ‘হিজড়া’ পরিচয়ের জন্য তাকে বাবা-মাসহ পরিবার ছাড়তে হয়। পরিবার ছেড়ে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে তার পক্ষে। পরিবার ছাড়ার পর ৩ থেকে ৪ মাস পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছে গেলেও তারা তাকে স্থান দেননি। এরই মধ্যে তার সঙ্গে পরিচয় হয় বিন্দু হিজড়া নামে একজনের সঙ্গে। তার সহযোগিতায় হিজড়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন পাখি দত্ত। আর্থিক ও সামাজিক দৈন্যতার কারণে চাঁদা তোলাসহ বিভিন্ন কাজে যেতে অস্বীকার করায় হিজড়া গুরুর কাছে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে পাখিকে। কখনো কখনো না খেয়ে থেকেছেন তিনি। এমনকি ট্রেনেও ভিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত করেছেন। এক সময় তিনি এই অমানবিক কষ্টকর জীবনের অবসান চেয়েছেন। চিরাচরিত হিজড়া পেশা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়তে চেয়েছেন। বিন্দু হিজড়ার সহায়তায় এনজিওতে কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৭ সালে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ‘হিম’ প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি উপলদ্ধি করেন সমাজে যারা পিছিয়ে আছেন বিশেষ করে হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য তাকে কিছু করতে হবে।
২০১৮ সালে চরম ঝুঁকি নিয়ে ১১ জন সমমনা বন্ধুদের সহযোগিতায় ‘নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন পাখি। এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ হিজড়া-ট্রান্সজেন্ডার লৈঙ্গিক বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদেরকে স্বাবলম্বী করা। যাতে তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে এসে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন। সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি সমাজ উন্নয়নে নানাবিধ কাজ করে চলেছেন। ইতোমধ্যেই এই সংগঠনের সঙ্গে সাড়ে ৩০০ হিজড়া এবং চার শতাধিক পিছিয়ে পড়া মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন। সংগঠনের মাধ্যমে ব্লাষ্ট, নাগরিক উদ্যোগ ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে পিছিয়ে পড়া হিজড়াদের উন্নয়নে কাজ করছেন।
বন্ধুর সঙ্গে পাখি দত্ত (ডানে)
পাখি দত্ত জানান, প্রথমে নক্ষত্র মানবকল্যান সংস্থা শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্য থাকলেও পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব ব্যয় নিজস্ব অর্থায়ন ও সদস্যদের চাঁদার মাধ্যমে আসছে। তিনি ইতোমধ্যেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির উন্নয়নে কাজ করে বেশকিছু সফলতাও পেয়েছেন।
তিনি আরও জানান, হিজড়া পরিচয়ে তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন বরং গর্বিত। দৃঢ়তা, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজীবন সামাজিক দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি হিজড়া সম্প্রদায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে চান এই কীর্তিমান নক্ষত্র। তিনি এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে চান যার মাধ্যমে হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের যথাযথ কর্মসংস্থান হবে। সব হিজড়াকে স্বাবলম্বী করতে কারিগরি ও বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। যেন যার যেমন দক্ষতা ও ক্ষমতা সে তেমনই কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। একমাত্র আর্থিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বী করার মধ্য দিয়েই হিজড়াদের চাঁদা তোলাসহ নানাবিধ কাজ থেকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য পাখি দত্ত একটি সুপার শপ করতে চান। একই সঙ্গে হিজড়াদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা করতে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের দাবিও জানান তিনি। তার এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।
খুলনা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসনা হেনা বলেন, পাখি দত্ত সমাজের দৃষ্টিতে একজন হিজড়া হয়েও তিনি একজন সংগ্রামী নারী। একজন সমাজ সেবক, একজন সফল সামাজিক নেত্রী, সমাজ পরিবর্তনের একজন এজেন্ট এবং একজন দক্ষ প্রশিক্ষক। একজন হিজড়া হয়েও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচি ২০২২-২৩ এ খুলনা বিভাগে ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন পাখি দত্ত। আমরা বিশ্বাস করি এই জয়িতাদের অনুপ্রেরণামূলক সাফল্যগাথা আরও অনেক নারীকেই অনুপ্রাণিত করবে।
তিনি আরও বলেন, হাজারো নারীর মনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঁকি দেওয়া স্বপ্নগুলো পাখা মেলবে আকাশে, তৈরি হবে লাখো জয়িতা হিজড়া পাখি দত্ত। এই সফল নারীদের অপরাজেয় রূপ দেখে সমগ্র সমাজ নারী বান্ধব হবে বলেও তিনি আশা করেন।