কুষ্টিয়ার চাষিদেরকে তামাক চাষে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো। এতে স্বপরিবারে তামাক চাষে ঝুঁকছেন অনেক চাষি। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের নিরুৎসাহিত করা হলেও তামাক চাষ কমানো যাচ্ছে না। চাষিরা বলছেন, শ্বাসনালীর সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা তামাক উৎপাদন করছেন। কারণ, তিন মাসে এই ফসল উৎপাদন করা সম্ভব এবং টোব্যাকো কোম্পানির সহায়তায় তামাক বিক্রি করা খুব সহজ। এতে লাভও বেশি পাচ্ছেন তারা।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, কুষ্টিয়ার ৬ উপজেলার মধ্যে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ করা হয়। অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও তামাক চাষ হয়ে থাকে। ২০১৯-২০ সালে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে। পরের বছর ২০২০-২১ সালে তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে, ২০২১-২২ সালে ১১ হাজার ৯২০ হেক্টর, ২০২২-২৩ সালে ১০ হাজার ৭৭১ হেক্টর এবং চলতি বছরে ১০ হাজার ৯৩১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৬৯৬ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৭৮০ হেক্টর এবং মিরপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। মিরপুর উপজেলায় কৃষি জমি ২৩ হাজার ১১১ হেক্টর, ভেড়ামারায় ১০ হাজার ৮৯১ হেক্টর এবং দৌলতপুর উপজেলায় কৃষি জমি রয়েছে ৩২ হাজার ৪৪৮ হেক্টর।
জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তামাক ক্ষেত। ক্ষেতে কেউ তামাক গাছের পরিচর্যা করছেন, কেউ নষ্ট পাতা কাটছেন। আবার কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তামাক ক্ষেতে সার দিচ্ছেন।
মিরপুর উপজেলার সদরপুর এলাকার তামাক চাষি উজ্জ্বল হোসেন বলেন, তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ খাটুনি। স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। তবে তামাক চাষে লাভ বেশি। প্রতি বিঘায় প্রায় এক লাখ টাকার তামাক বিক্রি হয়। প্রতি বিঘায় ৫ হাজার চারা লাগানো যায়। বিঘায় ১০ মণ শুকনো তামাক হয়। প্রতি কেজি শুকনো তামাক বিক্রি হয় প্রায় ২০০ টাকায়। খরচ হয় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। লাভ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তামাকের আবাদ তিন মাসে হয়ে যায়।
চাষি আরমান মন্ডল, বিশারত আলী, আকরাম হোসেন, আশাদুল হকসহ বেশ কয়েকজন বলেন, বোরো ধান চাষে খরচ অনেক বেশি কিন্তু তামাক চাষে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি। তামাকপাতা বিক্রির জন্য বাজারে-বাজারে ঘুরতে হয় না। সহজেই তামাকপাতা বিক্রি করা যায়। তামাক কোম্পানির লোকজন বাড়িতে এসে তামাক বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। তামাক চাষ করার জন্য চাষিদের উৎসাহিত করেন তারা। অগ্রিম ঋণে কার্ডের মাধ্যমে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো সার ও বীজ সরবরাহ করে থাকে।
দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুলমত হোসেন বলেন, চাষিদের সুবিধার জন্য কোম্পানিগুলো বিভিন্ন এলাকায় অনেক বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন তৈরি করেছে। তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনও অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধরনের এত উদ্যোগ দেখা যায়নি। এসব কারণেই কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে তামাকের চাষ হয়। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক ও তৎপর। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে ধান, ভুট্টা, গম, আলুসহ ফল চাষে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কৃষকদের সরকারি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা সচেতন হলে তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসবেন।
মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পিষুস কুমার সাহা বলেন, তামাক স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তামাকের গুঁড়া বাতাসের সঙ্গে মানুষের শ্বাসনালি দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তামাক ফুসফুসের ক্ষতি করে। এই তামাকের কারণে মানুষের ব্রঙ্কাইটিস, এজমা, টিবিসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এ ধরনের রোগীরা অনেকেই তামাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত।