সারা বাংলা

বগুড়ায় স্বাস্থ্য’র ৩২ আউটসোর্সিং কর্মচারীর ২২ মাসের বেতন বকেয়া

বগুড়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৩২ আউটসোর্সিং কর্মচারীর ২২ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। এরকম অবস্থায় ঠিকাদারও লাপাত্তা রয়েছেন। এদিকে জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তাদের কাজ থেকে অব্যাহতির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) এ সমস্যার সুরাহা পেতে আউটসোর্সিং কর্মচারীরা দরখাস্ত নিয়ে বগুড়া সিভিল সার্জন অফিসে অবস্থান নেন। কিন্তু জেলা স্বাস্থ্যবিভাগও নিজেদের কোনো দায় নেই বলে তাদের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন ঐ ৩২ জন কর্মচারী।

চুক্তিভিত্তিক এই সেবাপ্রদানকারীদের কাছে থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মেসার্স সারমী টেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম বগুড়া জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগের ঠিকাদারি পায়। পরবর্তীতে তাদের ওই কার্যক্রমের মেয়াদ প্রতিবছর বৃদ্ধি হয়ে আসছে।

এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকিট কালেক্টর, বাবুর্চি পদে সেবা ক্রয় করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে টিকিট কালেক্টরের বেতন প্রতিমাস ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা। আর বাবুর্চিদের বেতন ১৬ হাজার ১৩০ টাকা করে নির্ধারণ করা আছে।

তবে ২০২১-২০২২ পর্যন্ত এই ৩২ সেবাপ্রদানকারী কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পেয়ে এসেছেন। কিন্তু এর পর থেকে তাদের বেতন অজ্ঞাত কারণে আটকে যায়। এই বেতনও কাউকে সঠিকভাবে প্রদান করা হতো না বলে অভিযোগ কর্মচারীদের। প্রতি মাসের বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে তাদের দেওয়া হতো। যদিও তারা পূর্ণ বেতন পেয়েছেন মর্মে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ১ এপ্রিলের এই আদেশটির স্মারকটি ২০২৪ সালের। কিন্তু এই আদেশে স্বাক্ষর করা হয় ২০২৩ সালের ২৯ জুন। এই আদেশ ওই সময় না দিয়ে এতদিন পর দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের মাঝে। কারণ ২০২৩ সালের ২৫ জুলাইয়ে এই কার্যক্রমের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে এই সেবাপ্রদানকারীরা কাজ করে আসছিলেন।

মরিয়ম খাতুন নামের একজন আউটসোর্সিং কর্মচারী বলেন, তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট কালেক্টর পদে কাজ করেন। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত ২২ মাস ধরে তিনি কোনো বেতন পাননি। তাদের বেতন দেওয়া হয় সেবাপ্রদানকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মরিয়ম খাতুন আরো বলেন, আমি তিন বছর যাবত শিবগঞ্জে হাসপাতালে আছি টিকিট কালেক্টর হিসেবে। এই যে একটা ঈদ যাচ্ছে, আমরা কিছুই কিনতে পারছি না বাবা-মায়ের জন্য। তারপর ঈদের আগে বোনাস চাইছি, তখন জানতে পারলাম আমাদের নাকি চাকরি নাই ১০ মাস আগে। ব্যাক ডেটে এই নোটিশ দিছে। আমরা এখন কি করব? আমাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ১০ মাস বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার পরেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।

আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাবুর্চি আদরী বেগম জানান, তিনি ২২ মাস ধরে বেতন পান না। তার একটা ছোট বাচ্চা আছে। খুব কান্না করছে। সামনে ঈদ, বাচ্চাকে কোনো কাপড় কিনে দিতে পারছেন না।

বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বেতন ১৬ হাজার ১৩০ টাকা। কিন্তু আমি কখনও ওই বেতন পাইনি। আমাকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো ১৩ হাজার টাকা। বাকি টাকা ঠিকাদার নিয়ে নিতেন। বিভিন্ন সময়ে এই কর্মচারীরা ঠিকাদার আশরাফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান মিলেনি। এই মের্সাস সারমী ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম নওগাঁ সদরের পারনওগাঁর বাসিন্দা। পরবর্তীতে বেশ কয়েক মাস ধরে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ কেউ করতে পারছেন না। আশরাফুল ইসলামের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকে।

সোনাতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট কালেক্টর এস এইচ রেজ্জাকুল ইসলাম বলেন, আমরা ঠিকাদার আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এতদিন বলতেন কাজ চলমান আছে। প্রত্যেক মাসে বলেন কাজ চলমান। জানুয়ারিতে গেলে বলে ফেব্রুয়ারিতে বেতন পাবেন। ফোন করলে ফোন ধরেন না। কিন্তু কাজ হয় না। জেলা সিভিল সার্জনের কাছে গেলে তিনিও আমাদের দায়ভার নিতে চান না। তিনি বলেন, আপনারা আমাদের কর্মচারি না। তাহলে আমরা কার কাছে যাবো? কার কাছে গেলে সুরাহা পাবো?

এসব বিষয় জানতে সারমী টের্ডাসের মালিক আশরাফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তার নম্বর বন্ধ। এমনকি জেলা সিভিল সার্জন তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ঘটনা আগে থেকেই জানতেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম। কিন্তু এখানে তাদের কিছু করার নেই বলে দাবি করেছেন। কারণ ঠিকাদার নিয়োগ মন্ত্রনালয়ের বিষয়।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম বলেন, তাদের মূলত যোগাযোগ করতে হবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে। আমাদের কাছে আসার কিছু নেই। তারপরেও মানবিক দিক বিবেচনায় কথা বলেছি। যেহেতু তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন যদি মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হয় তাহলে তারা কাজ করতে পারবে। মানবিক দিক থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে যেন নতুন ঠিকাদার এলেও তারাই থাকতে পারে। গত অর্থবছরের বকেয়া বেতন নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এটি ঈদের পরে পরিশোধ করার কথা জানিয়েছে ঠিকাদার।

কেন বকেয়া হয়েছিল এমন প্রশ্নে সিভিল সার্জন বলেন, সমন্বিত বাজেট ও হিসাব সংরক্ষণপদ্ধতিতে (আইবাস) ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বেতন এই কর্মচারীদের ব্যাংক হিসাবে এসেছিল। কিন্তু আইবাস পদ্ধতিতে টাকা আসার পরপরই টাকা উইথড্রো হয়ে যায়। যার জন্য ওই সময় টাকা তুলতে পারেননি সেবাপ্রদানকারী ওই কর্মচারীরা।