বেনারসি শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ঈদ মৌসুমেও অলস সময় পার করছেন বেনারসি পল্লির কারিগররা। বেনারসি পল্লিতে নেই আগের মতো ঈদের কর্মচাঞ্চল্য। এই বেনারসি পল্লি ঘিরে গড়ে ওঠা শাড়ির মার্কেটও এখন ক্রেতাশূন্যপ্রায়। এ চিত্র পাবনার ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির।
ঈদের আগে ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লি ঘুরে কারিগর ও শাড়ি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে এ চিত্রের সত্যতা মিলেছে।
তিন বছর আগেও ঈশ্বরদীর তৈরি বেনারসি শাড়ি যেতো ভারতে। অথচ দফায় দফায় সুতাসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে ভারতীয় শাড়ির সহজলভ্যতার কারণে এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্য ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লিতে অনেকটাই নিরবতা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে গড়ে উঠা শত বছরের পুরোনো ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী বেনারসি পল্লি ঈদ এলেই তাঁতের খটখট শব্দ আর ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর থাকতো। কিন্তু এবার ঈদে ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকার চিত্র ভিন্ন। পৌর শহরের বিহারি পাড়া, ফতেমোহাম্মদপুর এলাকার বেনারসি পল্লিতে কারিগরদের কাজের তৎপরতা নেই। ঈদ ঘিরে বেনারসি পাড়ায় কোনো প্রাণচাঞ্চল্যও নেই।
কিছুদিন আগেও দক্ষ কারিগরের নিখুঁত বুননের জন্য এখানকার তাঁতের তৈরি বেনারসি শাড়ির ব্যাপক কদর ছিল। করোনা মহামারির পর দফায় দফায় সুতার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট ও দেশীয় বাজারে ভারতীয় শাড়ির সহজলভ্যতায় বেনারসি পল্লির অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে। লোকসান গুনে গুনে দিশেহারা হয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেক কারিগরও। অনেক দক্ষ কারিগরদের মধ্যে এখন কেউ কেউ রিকশা চালিয়ে কিংবা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
বেনারসি পল্লির বাসিন্দা ঈশ্বরদী শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক নির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন খান আল-আমিন বলেন, ‘এখানে এক সময় ৪৫০টি বেনারসি কারখানা ছিল। হাজার হাজার কারিগর এ কাজে জড়িত ছিল। এখন মাত্র ৫০টি কারখানা চালু রয়েছে। ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে দেশীয় বাজার সয়লাব ও দফায় দফায় সুতা, চুমকিসহ তাঁত সামগ্রির দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসানে পড়ে অনেকেই বেনারসি তাঁত শিল্প থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।’
আল-মদিনা বেনারসি সিল্ক হাউজের মালিক সেলিম বেনারসি বলেন, ‘আগে ঈদ এলেই দিনরাত কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। শাড়ির ব্যাপক চাহিদাও ছিল। এখন বাজারে ভারতীয় শাড়ি সহজেই পাওয়া যাচ্ছে, সে কারণে আমাদের শাড়ির চাহিদা কমে গেছে। বিদেশি শাড়ির তুলনামূলক পার্থক্য হলো ঈশ্বরদীর বেনারসি শাড়ি হ্যালো লুমে বুনানো হয়, যার ফলে গুণগতমান এবং টেকসই অনেক বেশি। বাহারি ডিজাইনের জন্য ঈশ্বরদী বেনারসি শাড়ি সারাদেশে এক নামে পরিচিত।’
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির মদিনা টেক্সটাইলের শ্রমিক সোলেমান হোসেন বলেন, ‘এখানে তৈরি বেনারসি শাড়ি ২ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লিতে ক্যালেন্ডার মেশিন না থাকায় এখানে তৈরি শাড়ি ঢাকার মিরপুরে নিয়ে ক্যালেন্ডার করে বাজারজাত করতে হয়। এতে প্রতিটি শাড়ির জন্য অতিরিক্ত ৩-৪শ’ টাকা খরচ গুনতে হয় তাদের।’
শামীম বেনারসি কারিগর জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে বেনারসি পল্লি¬তে তাঁতের কারিগর হিসেবে কাজ করছি। এবারের ঈদের মতো খারাপ সময় আগে কখনো দেখিনি।’
ঈশ্বরদী বেনারসি তাঁতী সমিতির সভাপতি ওয়াকিল আলম বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদে বেনারসি শাড়ির যে চাহিদা ছিল এবার তার অর্ধেকও নেই। এখানকার বেশিরভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। শাড়ির ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।’
শামীম বেনারসি কারখানার স্বত্বাধিকারী শামীম হোসেন বলেন, ‘বেনারসি শাড়ির ব্যবসা ধ্বংসের পথে। অন্য বছর ঈদে কমবেশি শাড়ির চাহিদা থাকতো, এবার কোনো ধরনের চাহিদা নেই। কারিগরদের বেতন দিতে পারছি না।’
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির গাউছিয়া মার্কেটের ‘পল্লি বেনারসি’র মালিক সাঈদ হোসেন রুবেল বলেন, ‘আমার কারখানায় ২২টি তাঁতের মধ্যে এখন মাত্র ৫টি চলছে। ঈদে শাড়ির কোনো চাহিদা ও অর্ডার নেই। আগে এখানকার শাড়ি টাঙ্গাইল ও ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ীরা কিনতেন। এবার ঈদে তারা কোনো অর্ডার দেয়নি।’
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে তাঁতীদের মধ্যে ঋণ সুবিধা প্রদান করে এই বেনারসি পল্লির কারখানাগুলো চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’