বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শনিবার (৬ এপ্রিল) রাত থেকে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দুটি অস্ত্র ও কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।
রোববার (৭ এপ্রিল) সকালে হেলিকপ্টারে বান্দরবানে এসে বান্দরবান ৬৯ সেনা রিজিয়নে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় শেষে বেলা সাড়ে ১২টায় সেনা রিজিয়ন মাঠে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
সেনাপ্রধান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশে গতকাল রাত থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দুটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য শান্তি আলোচনা চলছিল। দুটি মুখোমুখি সংলাপ বৈঠকও হয়েছে, তৃতীয় বৈঠকের আগে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাল। গত মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাল, মনের ভিতরে কী আছে, সেটি জানা মুশকিল। সরকার তাদের বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু কেএনএফ বিশ্বাস রাখেনি।’
সেনা প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যৌথ অভিযান, গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে। অপারেশনের সবগুলো দৃশ্যমান নয়, কিছু কার্যক্রম অদৃশ্যে চলবে, যা সাধারণ মানুষ দেখবে না, কিন্তু সুফল ভোগ করবে।’
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিস্ত প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের শুরুর দিকে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে এ সংগঠন গঠন করার কথা বলা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। সে কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফ বলছে, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ গঠন করতে চায় তারা।
সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে ২০২২ সালে খবর দেয় র্যাব।
কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও অগাস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়।
পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মত কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
‘শান্তি আলোচনা’ শুরুর পর পাহাড়ে হত্যা-সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরইমধ্যে ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন।
তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং এক ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।
দুটি ঘটনাতেই কেএনএফ এর নাম আসার পর ৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর ‘সম্ভব নয়’।
এদিকে, বান্দরবানের থানচি ও রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে হামলা, টাকা ও অস্ত্র লুট, ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত আটটি মামলা করা হয়েছে। এরমধ্যে রুমায় চারটি এবং থানচিতে চারটি মামলা করা হয়েছে। সব মামলায় আসামি অজ্ঞাত। বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন এ তখ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ সুপার বলেন, রুমার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম, পুলিশ ও আনসার এবং থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা বাদী হয়ে। পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন। এখন পর্যন্ত মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। হামলা ও লুটকারীদের ধরতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও আলীকদম সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে।
ব্যাংক ডাকাতির পর থেকে নিরাপত্তার কারণে রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের সকল লেনদেন বন্ধ রয়েছে। এ তিন উপজেলার গ্রাহকরা বান্দরবান সদর শাখায় লেনদেন করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম।