রাজশাহীতে ধূমকেতু দেখানোর নামে শত শত তরুণ-তরুণীকে ডেকে রীতিমতো অপমান করেছে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও রাজশাহী অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার। অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপ সামলাতে না পেরে দুর্ব্যবহার করে তাদের আয়োজনের স্থান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ৭১ বছর পর পর ১২ পি/পন্স-ব্রুকস নামের ধূমকেতুটি দেখা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানি ধূমকেতুটির নাম দিয়েছেন ‘শিংওয়ালা ধূমকেতু’ বা ‘ডেভিল কমেট’। জ্যোতির্বিজ্ঞানিরা জানান, রোববার (২১ এপ্রিল) সূর্যাস্তের সময় থেকে ঘণ্টাখানেক ধূমকেতুটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে আকাশে অবস্থান করে।
রাজশাহীতে টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিরল এই ধূমকেতু দেখার আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও রাজশাহী অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ধূমকেতু দেখাবে বলে কয়েক দিন ধরে প্রচারও চালায়। বলা হয়, সন্ধ্যা সোয়া ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের টি-বাঁধে ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। আগ্রহী সবার জন্য ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প উন্মুক্ত থাকবে। ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বৃহস্পতি গ্রহ এবং চাঁদ দেখার আয়োজনও থাকবে।
তাদের এই প্রচারণা দেখে বহু তরুণ-তরুণী বিকাল থেকে পদ্মার পাড়ে ভিড় জমান। মূহুর্তে টি-বাঁধ এলাকায় তরুণ-তরুণীর ভিড় লেগে যায়। কিন্তু তখন হঠাৎ করে নাম নিবন্ধন শুরু করে আয়োজকেরা। মাত্র ১০০ জন তরুণ ও ১০০ জন তরুণীকে নাম নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ নাম নিবন্ধন ছাড়া টেলিস্কোপে চোখ রাখা যাবে না তা আগে থেকে বলা হয়নি। আয়োজকেরা তাদের টেলিস্কোপ দিয়ে ধূমকেতুও দেখাতে পারেননি।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আকাশে মেঘ থাকার কারণে ধূমকেতু দেখা যাচ্ছে না। অথচ রাজশাহীর আকাশ অনেকটাই মেঘমুক্ত। টানা তীব্র তাপদাহের কারণে মানুষ বৃষ্টির জন্য মুখিয়ে থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। আয়োজকেরা ধূমকেতু দেখাতে না পেরে শেষে শুধু চাঁদ দেখানো শুরু করে। একেকজন দর্শনার্থীকে চাঁদ দেখতে দুই-তিন সেকেন্ড টেলিস্কোপে চোখ রাখতে দেওয়া হয়। বৃহস্পতি গ্রহ দেখানোর কথা বলা হলেও তা কাউকেই দেখানো হয়নি।
তুমুল ভিড়ের মধ্যে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মশহুরুল আমিনকে দর্শনার্থীদের কাউকে কাউকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে দেখা যায়। আয়োজকেরা বলেছিলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প চলবে। কিন্তু ১০ মিনিট আগেই টেলিস্কোপ গুটিয়ে নেওয়া হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ধূমকেতু দেখতে আসা দর্শনার্থীরা।
শুধু এই ধূমকেতু দেখার জন্য রাজশাহী এসেছিলেন ঢাকার আদাবরের ফারুক হোসেন। টেলিস্কোপ গুটিয়ে নিতে দেখে তিনি আয়োজকদের বলেন, তাঁর বাড়ি ঢাকায়। তিনি একটি আইটি সেন্টারে চাকরি করেন। ধূমকেতু দেখার আয়োজনের কথা জেনে ছুটি নিয়ে রাজশাহী এসেছেন। কিন্তু ধূমকেতু, চাঁদ কিংবা বৃহস্পতির কিছুই দেখতে না পেয়ে ফারুক হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
রাজশাহী অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের সভাপতি আহসান কবির লিটন বিষয়টি দেখতে পেয়ে ফারুককে শান্ত করেন। তিনি ফারুককে বলেন, ‘আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন! চলেন আপনাকে চা খাওয়াই।’ তবে ফারুককে তিনি চা পান করাননি। টেলিস্কোপে চোখ রাখারও সুযোগ করে দেননি।
রাজশাহীর নওদাপাড়া থেকে ধূমকেতু দেখতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইয়াজ উদ্দিন নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘টেলিস্কোপে চোখ রাখতে এখানে এসে নাম নিবন্ধন করতে হবে এটা আয়োজকেরা আগে জানাননি। মাত্র ২০০ জনকে সুযোগ দেওয়া হবে সেটিও বলা হয়নি। এখানে কয়েক হাজার দর্শনার্থী এসেছে। আমার মতো বেশিরভাগই ফিরে গেল।’
রাজশাহীর একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোমা হাসান ধূমকেতুর বদলে চাঁদ দেখে বললেন, ‘এসেছিলাম পোলাও খেতে। সাদাভাত খেয়ে ফেরত যাচ্ছি। এরা বলেছিল, ধূমকেতু দেখাবে, কিন্তু দেখাল চাঁদ। বৃহস্পতিটাও দেখাল না। টেলিস্কোপে যে চাঁদ দেখলাম তার চেয়ে ভালো আমার মোবাইলেই দেখা যায়।’
পদ্মাপাড়ে ধূমকেতু দেখানোর জন্য শত শত তরুণ-তরুণীকে জড়ো করলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশকে আগে থেকে কিছু জানায়নি আয়োজকেরা। ফলে তুমুল ভিড় দেখে ছুটে আসেন একদল পুলিশ সদস্য। তারা জানান, এ ধরনের আয়োজন করতে পুলিশের অনুমতি প্রয়োজন। আয়োজকেরা অনুমতি তো দূরের কথা; পুলিশকে অবহিত পর্যন্ত করেননি। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গেই হট্টগোলে জড়িয়ে পড়েন আয়োজকদের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।
আয়োজনে এ ধরনের বিশৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের সভাপতি আহসান কবির লিটন বলেন, ‘আসলে আমি নাটকের মানুষ। নাটকের আয়োজন করলে মানুষ দেখতে আসে না। এখানে একসঙ্গে এত মানুষ চলে আসবে সেটা বুঝতে পারিনি। তা না হলে আগে থেকেই বলে দেওয়া হতো যে মাত্র ২০০ জনকেই সুযোগ দেওয়া সম্ভব।’
তারপরও তরুণ-তরুণীদের অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে আগ্রহ দেখে খুশি আহসান কবির লিটন। তিনি বলেন, ‘এই আগ্রহটা আমাদের কাছে ভালো লেগেছে। ভবিষ্যতে যখন আয়োজন করব, তখন সবকিছুই বিবেচনা করা হবে।’