টানা রোদ আর তাপপ্রবাহে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল পাট ক্ষেতের সবুজ চারা নুয়ে পড়েছিলো। কুঁচকে পড়া পাতা আর অনাবৃদ্ধির ফলে চিন্তিত কৃষকের কপালে দেখা দিয়েছিলো দুশ্চিন্তার রেখা। এ অবস্থায় মোটা অংকের টাকা খরচ করে জমিতে সেচ দিয়ে ক্ষেতের ফসল রক্ষাই ছিলো তাদের একমাত্র চিন্তা। কিন্তু গভীর নলকুপেও যেনো পানি উঠছিলো না, সেচের খরচও তাই বাড়ছিলো।
এ অবস্থায় দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানের পরে সম্প্রতি প্রায় পুরো ফরিদপুর জেলা জুড়েই খণ্ড খণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। আর এতেই লকলকিয়ে আড়মোড়া ভেঙে সজীব হয়ে উঠেছে পাটের ক্ষেত।
কৃষক বলছেন, এই বৃষ্টিতে তাদের উপকার হয়েছে। এবার আর পানির জন্য অতিরিক্ত সেচ দিতে নগদ টাকা গুনতে হচ্ছেনা তাদের। আর জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, এ বৃষ্টিতে ফরিদপুর জেলায় পাটচাষিদের সেচ বাবদ সাশ্রয় হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলায় ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। আর প্রতি হেক্টর জমিতে একবার সেচ দিতে কৃষকের খরচ হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
ফরিদপুরের আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাট চাষের উপযুক্ত মাটি এবং আবহাওয়া এবং পাট জাগ দেওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকার কারণে ফরিদপুরে আবহমানকাল ধরে পাটের আবাদ হয়ে আসছে। এখানকার নদ-নদী, খাল, বিল, বাওড়, পুকুর ও জলাশয় থাকায় এখানকার কৃষককে পাট জাগ দিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়না। এজন্য দেশের পাট চাষে এই জেলার অবস্থান শীর্ষে। বিপুল পরিমাণে পাট আবাদ হওয়ায় ফরিদপুরকে পাটের রাজধানীও বলা হয়। জেলার সবকটি উপজেলায় পাটের আবাদ হলেও সালথা ও নগরকান্দা উপজেলাতে পেঁয়াজের মতোই সবচেয়ে বেশি পাটের আবাদ করা হয়। এবছর এ দু'টি উপজেলাতে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছে। তবে প্রতিবার বৃষ্টিতে মাটি নরম হওয়ার পরে বীজ রোপণ করলেও এবার বৃষ্টি নামেনি। তাই মৌসুমের শুরু থেকেই সেচ দিয়েই শুরু হয়েছে পাটের আবাদ। আর বীজ রোপণের পর গত প্রায় দেড় মাসে ক্ষেতের মাটি ভেজাতে অনেককে দু'তিনবার করেও সেচ দিতে হয়েছে। এজন্য এবার পাট চাষের খরচও বেড়ে গেছে শুরু থেকেই।
সালথার বাইলাগট্টি গ্রামের মিজান শেখ (৬৮) নামে একজন পাটচাষি বলেন, আমার এই জীবনে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে এমন খরা দেহি নাই। রোদের কারণে এইবার আমাগের অনেক খরচ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ২৮ শতকের এক পাখি ভুঁইতি সেচ দিতে পাঁচ-ছয় লিটার তেল লাগে। আর একেকটা ভুঁইতি দুই-তিনবার কইর্যা সেচ দিতি হইছে। এই জন্যি এইবারতো অনেক খরচ হইয়্যা গ্যাছে আমাগের। যাই হোক, শ্যাষম্যাস আল্লাহ এহন বৃষ্টি দিছে। এহন আর সেচ লাগবে নানে। এতে আমাগে অনেক টাকা বাইচ্যা গ্যাছে। আর্থিকভাবে আমরা ইট্টু উপকৃত হইছি।
নগরকান্দার ছাগলদি গ্রামের জলিল শেখ (৫৩) নামে একজন কৃষক বলেন, ভুঁইতে এইবার অনেক খরচা হইয়্যা গ্যাছে। এক পাহি ভুঁইতে একেকবারে সেচ দিতে কোথাও এক হাজার টাকাও লাগে। তিন-চাইরড্যা সেচ দিছি। এহন আল্লাহপাক বৃষ্টি দিছে, তারজন্যি ক্ষ্যাতটা নিরাপত্তা হইছে। পরে কি হবি সেইড্যা আল্লাহই জানে। তিনি বলেন, রোদের কারণে পাটে ছটকায় (পোকা) খাইতেছে। এও মারতি হবি।
মধুখালীর নওয়াপাড়া আবুল খায়ের মিয়া (৫২) বলেন, এইবার রোদের কারণে আমাদের পাটের অনেক ক্ষতি হইছে। পাট গাছ বাড়ে নাই। পোকামাকড় সহ নানাকারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হইছে। এইজন্য কৃষক সেচের মাধ্যমে ক্ষেতের পাট বাঁচায় রাখছে। এখন এই বৃষ্টি হওয়াতে কিছুটা হলেও কৃষকের উপকার হইছে। এই বৃষ্টি না হইলে কৃষকের আরো ক্ষতি হইতো। পাখি প্রতি আরো এক হাজার টাকা লসে পড়তো। অন্তত সেইটাকা বাইচ্যা যাওয়ায় আমরা এই বৃষ্টিতে অনেক উপকার পাইছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (শষ্য) অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. রইচউদ্দিন বলেন, কৃষকেরা মূলতঃ বৃষ্টির উপরে নির্ভর করেই প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাটের আবাদ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর প্রায় ত্রিশদিন যাবত টানা বৃষ্টিহীন তাপদাহ হয়েছে। এ কারণে ফরিদপুরের কৃষকদের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জমিতেই সেচ দিতে হয়েছে। এক হেক্টর জমিতে তাদের জমিভেদে চার থেকে ছয় হাজার টাকা প্রতিবারে খরচ হয়েছে। তবে এখন বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে কৃষকদের কাছে।