ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী বাজার। অজপাড়া গাঁ হওয়ায় চারিদিকে নিরিবিলি। জনবসতি তেমন নেই। এলাঙ্গী বাজার থেকে ফাঁকা মাঠের রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার গেলে প্রায় ২৫ বিঘার সীমানাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে সুবিশাল আলিশান বাংলোবাড়ি।
কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। বাংলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা কেউ কোটচাঁদপুরের নয়। দিনের বেলায় বাংলোবাড়ির মেইন গেট প্রায়ই তালাবদ্ধ থাকে। তবে, প্রায় রাতেই গেট খোলা হয়। সেখানে নামি-দামি গাড়িতে করে অপরিচিত লোকজন আসে। তখন অপরিচিত নারীদেরও আনাগোনা থাকে সেখানে।
প্রত্যন্ত গ্রামে সুবিশাল এই বাংলোবাড়ির মালিক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের। তারা বন্ধু ছিলেন। সেই বন্ধুত্বের সূত্রে আনোয়ারুল আজিমের সেখানে যাতাযাত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহীন কয়েক মাস পর পর দেশে আসেন। ঝিনাইদহে এলে নির্জন এলাকায় এই বাংলোবাড়িতে থাকতেন। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে ওই বাংলোবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক বন্ধ। ভেতরে কাউকে দেখা যায়নি। পরে রাইজিংবিডির সংবাদদাতা আকাশ থেকে ড্রোন ক্যামেরার সাহায্যে বাংলোবাড়ির কিছু দৃশ্য ধারণ করেন।
গত ১৩ ভারতের কলকাতায় খুন হন ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম। এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম। এর পর থেকে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কলকাতার নিউ টাউনে আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা ফ্ল্যাটেই ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে। তার আগে ওই ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ডের ছক কষে আক্তারুজ্জামান ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। তার সহযোগীরা ফ্ল্যাটে থেকে যান। আনোয়ারুল খুন হওয়ার পর আক্তারুজ্জামান গত সোমবার (২০ মে) ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন।
কোটচাঁদপুরের ছেলে আক্তারুজ্জামান শাহীন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কিছুদিন চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকরি করেন। অল্প কয়েক মাস চাকরির পর ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। দেশে ও বিদেশে নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তার কী ব্যবসা ছিল, গ্রামের কেউ তা বলতে পারেন না। শাহীন একসময় যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, সেখানে ব্যবসা করেন বলে এলাকার সবাই জানেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতেন, আবার চলে যেতেন। তবে, এলাকার রাজনীতিতে এবং নির্বাচন এলে অর্থ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি।
২৫ বিঘা বাংলোবাড়ির বিশাল পুকুর রয়েছে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটি ডুপ্লেক্স ভবন রয়েছে। পাশে অন্য একটি ভবন দেখা যায়। ভবনের সামনে রয়েছে সুইমিংপুল। প্রতিটি ঘরে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। বাংলোবাড়ির নিরাপত্তায় রয়েছে শতাধিক সিসি ক্যামেরা। এছাড়া, সেখানে ঘাস কাটার মেশিন ও একটি মাইক্রোবাস দেখা যায়।
এমপি আনোয়ারুল আজিমের বাল্যবন্ধু গোলাম রসুল বলেন, আনোয়ারুল ও আক্তারুজ্জামানের মধ্যে প্রায় ৩০ বছরের সম্পর্ক। তাকে (গোলাম রসুল) নিয়ে এমপি দুই বার ওই বাংলাবাড়িতে গিয়েছেন। চার মাস আগেও একবার গিয়েছেন।
গোলাম রসুল জানান, বাংলো দেখে তিনি হতবাক হন, যেখানে বিদেশি কুকুর, অনেক কর্মচারী, দাবি আসবাব দিয়ে সাজানো।
গ্রামের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ৬ বছর আগে প্রায় ২৫ বিঘা জমির ওপর তৈরি করা হয় এই বাংলোবাড়ি। তারা কখনও ভিতরে প্রবেশ করেননি। তবে, মাঠে কাজ করতে গিয়ে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে দেখেছেন। রাত হলে কাঁটাতারের চারপাশে আলো জ্বলে। কিন্তু, ভিতরে কী হচ্ছে, কেউ জানতে পারে না। রাতে বড় বড় গাড়ি আসতে দেখেছেন। সেই গাড়িতে নারীদেরও দেখেছেন।
এলাঙ্গী গ্রামের আকলিমা খাতুন বলেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে ওই বাংলোবাড়িতে আসতে দেখেছেন।
আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাই ও কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, এমপির হত্যার সঙ্গে আমার ভাইয়ের কথা উঠে এসেছে। যদি তদন্তে দোষী হয়, তাহলে তার শাস্তি চাই। তবে, বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমার ভাই এরকম কাজ করতে পারে।’