খুলনাসহ সারা দেশের মানুষের মুখে ছড়িয়ে পড়েছে শিমুল ভূঁইয়ার নাম। এখন সবার কৌতূহল তাকে নিয়ে। একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার পর সর্বশেষ তার নাম জড়িয়েছে ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার সঙ্গে। ইতোমধ্যে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের জালে গ্রেপ্তার হয়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঠান্ডা মাথার ভয়ঙ্কর এই খুনি।
শিমুল ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সম্পর্কে জানার জন্য সবার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম আগ্রহ ও কৌতূহল। সবার প্রশ্ন, কে এই শিমুল ভূঁইয়া?
শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ দুটি হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও বিস্ফোরকসহ খুলনার ফুলতলা, যশোর সদর থানা ও যশোরের অভয়নগর থানায় ৮টি মামলার খোঁজ পেয়েছে। তার বিরুদ্ধে আর কী কী মামলা রয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
আরও পড়ুন: এমপি আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ: তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে
প্রকৃত নাম মাহমুদ হাসান ভূঁইয়া (৫৪) হলেও ফুলতলা উপজেলায় শিমুল ভূঁইয়া নামেই তিনি পরিচিত। বিভিন্ন অঞ্চলে সৈয়দ আমানুল্লাহ, আমানুল্লাহ সাঈদ, শিহাব, আবুল ফজল, ফজল মোল্লা ও ফজলসহ বিভিন্ন ছদ্মনামে পরিচিত তিনি। এক কথায় বহুরূপী শিমুল ভূঁইয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার ফুলতলা উপজেলা সদরের দামোদর গ্রামের মৃত নাসির উদ্দিন শিমুল ভূঁইয়ার ৬ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে চতুর্থ শিমুল ভূঁইয়া। তার বড় ভাই লাকি ভূঁইয়া, মেজ ভাই মুস্তাক মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে বকুল ভূঁইয়া, তৃতীয় ওয়াজির মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে মুকুল ভুঁইয়া ওরফে হাত কাটা মুকুল, পঞ্চম পিপলু ভূঁইয়া ও ষষ্ঠ শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিপলু। তার দুই বোনোর নাম লিপি ও লুচি।
যুবক বয়সে শিমুল ভূঁইয়া
শিমুল ভূঁইয়ার ভাইদের মধ্যে লাকি ভূঁইয়া ফুলতলা বাজারের পানপট্টির ইজারাদার। বকুল ভূঁইয়া ফুলতলা বাজারের বাস স্ট্যান্ডে ইজিবাইক ও মাহিন্দ্রের ভাড়া আদায়কারী, মুকুল ভূঁইয়া ওরফে হাত কাটা মুকুল বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের সময় পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত, পঞ্চম পিপলু ভূঁইয়া পুলিশে চাকরিরত ও সবার ছোট শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিপলু দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। দুই বোনের মধ্যে ছোট বোন লুচির স্বামী নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) শীর্ষ নেতা মোফাখখারুল ইসলাম। তিনি দলের তাত্ত্বিক নেতাও।
শিমুল ভূঁইয়া ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে ভগ্নিপতি মোফাখখারুলের হাত ধরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় পার্টির আমলে ডুমুরিয়া উপজেলার রুদাঘরা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রার্থী ইমরান হোসেনকে সকাল ১০টার দিকে শোলগাতিয়া বাজারের একটি মিষ্টির দোকানে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শিমুল ভূঁইয়ার নাম প্রথম আলোচনায় আসে। এরপর একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হোসেনকে হত্যা করেন তিনি। এছাড়া, ফুলতলা উপজেলার পাশ্ববর্তী যশোরের অভয়নগর উপজেলার গণেশ নামে একজনকে ও ইমান আলী নামে আরেকজনকে হত্যা করা হয়। এ দুটি মামলায় শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন।
সূত্র জানায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফুলতলার দামোদর গ্রামের সরদার ও ভূঁইয়া পরিবারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দ্বন্দ্বের জেরে ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিস কক্ষের মধ্যে শিমুল ভূঁইয়া দামোদর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট তার বড় ছেলে একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদলকে বাড়ির সামনের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়। সরদার পরিবারের অভিযোগ, দুটি হত্যাকাণ্ডে শিমুল ভূঁইয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা সরাসরি জড়িত। এরমধ্যে আবুল কাশেম হত্যা মামলায় শিমুল, শিপলু ও মমিনুরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত থেকে তারা জামিনে বেরিয়ে আসেন। উক্ত দুটি মামলার বাদী ছিলেন সরদার আবুল কাশেমের আরেক ছেলে ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সে সময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠু।
বাবা ও ভাইয়ের মামলা আদালতে তদারকি করছিলেন মিঠু। এনিয়ে তার ওপর শিমুল ভূঁইয়াসহ তার বাহিনী কয়েক দফা হামলা চালায়। এছাড়াও, তাকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৬ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে দামোদর গ্রামের নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করা হয় সরদার আলাউদ্দিন মিঠুক। এ সময় তার শ্বশুর সৈয়দ সেলিম ও দেহরক্ষী নওশের গাজী গুলিবিদ্ধ হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে নওশের গাজী মারা যান। শিমুলের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তা খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। গত নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে, শিমুলের ভয়ে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়াতে সাহস করেনি কেউ।
দুই যুগ ধরে বাড়ি ছাড়া শিমুল ভূঁইয়া: হত্যাকাণ্ডসহ শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতা রয়েছেন ছোট ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিপলু ও বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়া। একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘ দুই যুগের ওপর বাড়ি ছাড়া শিমুল ভূঁইয়া। প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন কেউ তার খবর জানেন না।
গতকাল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২৪ মে) ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে শিমুল ভূঁইয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর তালাবদ্ধ। শুনসান নিরবতা। ছোট ভাই শিপলু ভূঁইয়ার বাড়িতেও কারো সাড়া পাওয়া যায়নি। পাশের আরেকটি বাড়িতে বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভূঁইয়া থাকেন। লাকি ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়াও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। লাকি ভূঁইয়ার বাড়িরটিও তালাবদ্ধ। জানালার কপাট খোলা থাকলেও ঘরের মধ্যে কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। তারা কোথায় তা জানেন না প্রতিবেশীরা।
শিমুলের বিরুদ্ধে ৮ মামলা: ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যশোর সদর, অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় এখন পর্যন্ত ৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দুটি হত্যা এবং চাদাঁবাজি, অপহরণ ও বিস্ফোরক আইনে মামলা রয়েছে। এছাড়া, আরো মামলা আছে কীনা তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
খুলনার পুলিশ সুপার সাঈদুর রহমান বলেন, শিমুল ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের বিষয়ে আমাদের কোনো কিছু জানা নেই।
শিমুল ভূঁইয়ার ফুফাতো ভাই পলাতক শাহিন: সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে পুলিশের কাছে চিহ্নিত পলাতক মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন সম্পর্কে জানা গেছে-তিনি শিমুল ভূঁইয়ার ফুফাতো ভাই। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে তার বাড়ি হলেও ফুলতলায় তাদের যাতায়াত রয়েছে। তবে, পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। শাহিন কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই।
আরও পড়ুন: এমপি আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ: তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে
আদালতে শিলাস্তির প্রশ্ন, আমি কীভাবে আসামি হই?
সুযোগ পেলে অবশ্যই রাজনীতি করবো, বাবা হত্যার বিচার চাই
কালীগঞ্জে কালো পতাকা উড়ছে, নেতাকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান সমর্থকরা
নির্জন গ্রামে শাহীনের আলিশান বাংলোবাড়িতে যাতায়াত ছিল আনোয়ারুলের
‘আব্বু তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল তাই না’
এমপি আনোয়ারুল হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দাবি নেতাকর্মীদের
নিখোঁজ এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের দাবি
নিখোঁজের আগে পিএকে ফোন করেছিলেন এমপি আনোয়ারুল
এমপি আনারের সন্ধান মেলেনি, কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের ভিড়
ভারত গিয়ে লাপাত্তা সংসদ সদস্য আনোয়ারুল