ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নিজের জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে বছরের পর বছর বিধবা ভাতার টাকা উত্তোলন করছেন কিছু নারী। বিষয়টি প্রকাশ হতেই এলাকাতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ভাতা বঞ্চিত সাধারণ নাগরিকরা। এমন অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার শাস্তির দাবি করেছেন তারা।
হাতিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য লক্ষিদিয়া গ্রামের মৃত নজরুল ইসলামের স্ত্রী কুলসুমা বেগমের বিধবা ভাতা উত্তোলনের মাধ্যমে ঘটনাটি জানাজানি হয়।
কুলসুমা বেগম গত তিন বছর ধরে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ মহিলা হিসেবে বিধবা ভাতা উত্তোলন করছেন। তার ভাতা পরিশোধের বই নং ৫৫৮। ভাতার বইতে স্বামীকে মৃত দেখানো হলেও আজও তিনি জীবিত আছেন। এমন কী তার পরিবারের অন্য সদস্যরা সুস্থ হওয়ার পরেও পাচ্ছেন প্রতিবন্ধী ভাতা।
কুলসুমা বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চরলটিয়া গ্রাামের মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে। তিনি উপজেলা সদর ওছখালী পুরাতন বাজারের একজন ব্যবসায়ী।
একই এলাকার মৃত আমিরুল ইসলামের স্ত্রী স্বপ্না বেগম নামে এক নারী ২০২১ সাল থেকে পাচ্ছেন বিধবা ভাতা। তার ভাতা পরিশোধের বই নং ৪৫৯। ভুয়া কাগজপত্র এবং তথ্য গোপন করে স্বামীকে মৃত দেখিয়ে ভাতার টাকা উত্তোলন করছেন তিনি। অথচ তার স্বামী আমিরুল ইসলাম জীবিত এবং স্বাবলম্বী।
কুলসুমা ও স্বপ্না বেগমের মতো অনেকে জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে বিধবা, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সব ধরণের ভাতার সুবিধা নিচ্ছেন। অথচ সমাজে এখনো অনেক অসহায় মানুষ রয়েছেন যারা উপযোগী হয়েও ভাতা পাচ্ছেন না। অনেকে একাধিকবার আবেদন করেও ভাতার তালিকায় নিজের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারেননি।
জানতে চাইলে কুলসুমা বেগম প্রথমে ভাতা পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমার স্বামী আছেন। আমার বাড়ির পাশের এক ব্যক্তি রহমত কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে ভাতার কার্ড ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আমিরুল ইসলামের স্ত্রী স্বপ্না বেগমকে ভাতার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে প্রথমে তিনি স্বামী নেই বলে জানান। পরে বলেন, অভাবের কারণে আমি কমিশনারের মাধ্যমে বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছিলাম। আবেদনের কারণে আমাকে ভাতা দেওয়া হয়।
কুলসুমা বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম ও স্বপ্না বেগমের স্বামী আমিরুল ইসলামের কাছে স্ত্রীদের বিধবা ভাতা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তারা এবিষয়ে অবহিত নন। এর বেশি তারা কিছু বলতে চাননি।
হাতিয়া উপজেলা সমাজসেবা অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৯ হাজার ৯৮৪জন সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনীর ভাতা ভোগী রয়েছেন। তার মধ্যে বয়স্ক ভাতা পান ১৮ হাজার ৭১৪জন, বিধবা ভাতা পান ৯ হাজার ৯৯২ জন, প্রতিবন্ধী ভাতা পান ১১ হাজার ৩৩ জন, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি প্রাপ্ত ৫৩ জন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ১৬৯ জন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি পান ২৩ জন। এসব উপকারভোগীদের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি অবৈধভাবে ভাতা সুবিধা নিচ্ছেন বলে স্থানীয় পর্যায় থেকে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, জনপ্রতিনিধি এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা স্বজনপ্রীতি ও অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দিয়ে সমাজ সেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এসব অনিয়ম করছেন। জনপ্রতিনিধিরা ইচ্ছেমতো নম্বর দিয়ে একাউন্ট করে নিজেদের পছন্দের লোকদের ভাতা পাইয়ে দিচ্ছেন। আবার প্রকৃত ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত হলেও জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোক না হলে তার ভাতার কার্ড হয় না।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঝাড়ুদার রোকেয়া বেগম (৫২) নামের এক বিধবা নারী বলেন, ২০০১ সালে আমার স্বামী মারা যান। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিনপার করছি। আমি কয়েকবার এলাকার ওয়ার্ড মেম্বারের মাধ্যমে বিধবা ভাতার আবেদন করি। কিন্তু, আজ পর্যন্ত বিধবা ভাতার কার্ড করতে পারিনি।
হাতিয়া পৌরসভা ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রহমত উল্লাহ বলেন, এখানে সমাজসেবা অফিসেও সরাসরি অনেক কাজ হয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিবেচনাতেও কিছু কাজ হয়ে থাকে। অনেক কাজই আমরা অবহিত থাকি না।
হাতিয়া উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা কাজী মো. ইমরান হোসেন বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যয়নের মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা অনলাইনে আবেদন করেন। আমাদের কাছে শুধুমাত্র অনলাইনের আবেদন করা ফরমগুলো জমা দেওয়া হয়। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের যেভাবে লাইভ ভেরিফাই (শনাক্ত) করা যায়, সেভাবে বিধবা ভাতা প্রত্যাশীদের ভেরিফাই করার সুযোগ হয় না। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হলাম। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।