সারা বাংলা

আয় আর একটি বার আয়রে সখা…

প্রায় ৩০ বছর পর দেখা হাইস্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধু-বান্ধবী সহপাঠীর সঙ্গে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাসি-কান্না আর খুনসুটিতে মেতে ওঠা। প্রিয় স্কুল চত্বর ঘুরে ঘুরে পুরনো সেইসব দিনের স্মৃতি স্মরণ করে আবেগে ভাসা।

এমনই দিনভর আড্ডা আর উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৩-৯৪ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা ও সংবর্ধনা। বিদ্যালয়টি ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘বন্ধুর টানে বন্ধুর প্রাণে এসো মিলি প্রাণের বিদ্যাপিঠে’— স্লোগানে ঈদুল আজহার পরের দিন মঙ্গলবার (১৮ জুন) অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ওই স্কুলের ১৯৯৩-৯৪ এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

সকাল থেকে প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে থাকেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে আসেন পরিবারের সদস্যরাও। মিলনমেলা উপলক্ষে স্কুল সাজানো হয় নানারঙে। নির্মাণ করা হয় তোরণ। করা হয় আলোকসজ্জা। স্কুল চত্বরে স্থাপন করা হয় মঞ্চ। স্কুলের প্রধান ফটকে ঢুকতেই স্থাপন করা বুথে রেজিস্ট্রেশন করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা পেশায় কর্মরত কৃতী শিক্ষার্থীরা। রেজিস্ট্রেশনের পর প্রত্যেককে দেওয়া হয় টি শার্ট ও ক্যাপ।

এরপর স্কুল চত্বরে পা রাখতেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে। স্মৃতিতে ভাসতে থাকে ৩০ বছর আগের পুরনো দিনের কথা। এর মাঝেই দেখা হয়ে যায় প্রিয় বন্ধু বান্ধবী আর সহপাঠীদের সঙ্গে। জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন৷ কেউ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

তারপর কেমন আছিস বল, কোথায় আছিস, কী করছিস, ছেলে-মেয়ে কয়টা— এমন নানা খোঁজখবর নেওয়ার মাঝে জমে ওঠে আড্ডা। পুরনো সব মজার স্মৃতির কথা মনে করে চলে খুনসুটি। এসব বন্ধু বান্ধবী সহপাঠীদের কেউ সরকারি চাকরীজীবী কেউবা ব্যবসায়ী।

কিছুক্ষণ পর স্কুলে একে একে হাজির হন প্রাক্তন শিক্ষকরা। যাদের আদর-শাসনে ভয়ে কাঁপতেন তারা। দীর্ঘ বছর প্রিয় স্যারদের কাছে পেয়ে ছুটে যান কাছে৷ কুশল বিনিময় করেন। কেউবা স্যারের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। শারীরিক খোঁজখবর নেন। শিক্ষকরাও এক সময়ের মেধাবী ও প্রিয় ছাত্রদের কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন, মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেন।

দিনব্যাপী আয়োজনের শুরুতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাদ্যবাজনাসহ বের করা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নেচে গেয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রাটি স্থানীয় সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

এরপর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার পর বেলুন উড়িয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রওশন আলী। এ সময় অন্যান্য অতিথি ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। পরে বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক আখেজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণ।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিদ্যালয়ের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব ইসমাইল হোসেন। বিশেষ অতিথির হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক সদর উদ্দিন, সাবেক শিক্ষক আফতাব হোসেন, প্রাক্তন কৃতী শিক্ষার্থী ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রকৌশলী ওসমান গণি, কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আব্দুর রহিম।

প্রাক্তন কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মৃতিচারণমুলক বক্তব্য রাখেন বেসরকারি সংস্থা পিসিডির নির্বাহী পরিচালক আলহাজ্ব শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সালাউদ্দিন সেলিম, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক নুরে আলম মেহেদী সনজু, চাটমোহর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, ভূমি কর্মকর্তা আফসার আলী।

স্বাগত বক্তব্য রাখেন মিলনমেলা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ১৯৯৩ সালের এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক ১৯৯৪ সালের এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী মিলন মল্লিক।

বক্তব্যকালে ওসমান গণি বলেন, ‘শিক্ষকদের আজও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। সম্মান করি। শ্রদ্ধায় মাথানত করি। জলিল স্যারের কাছে আমার আজন্ম ঋণ। আমার বন্ধু জহুরুল খুব ভালো গান গাইত। সে এমন টান দিত টিনের ঘরে কাঁপত।’

ড. সালাউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘সদর উদ্দিন স্যার স্বরচিত কবিতা পাঠ দিয়ে শুরু করতেন ক্লাসের পাঠদান। তার চোখের দিকে তাকাতাম না। কারণ তার চোখের দিকে তাকালে তিনি পড়া ধরতেন। সাইদুল স্যার হাতের আঙুলের ফাঁকে বেত দিয়ে ডলা দিতেন৷ তার শাসন ছিল। আলো স্যার ছিলেন স্মার্ট শিক্ষক। তার স্কাউটিং ছিল অন্যতম। আফতাব স্যারের পাঠদান ছিল আলাদা রকম। সহজেই বোঝা যেত।’

উৎসবের আহ্বায়ক-যুগ্ম আহ্বায়ক আমজাদ হোসেন ও মিলন মল্লিক বলেন, ‘চমৎকার একটা অনুভূতি। আমাদের বন্ধু-বান্ধবীরা অনকে বছর পর একসঙ্গে হলাম, আনন্দ করলাম। এত বছর পর একসঙ্গে হতে পেরে আমরা অনেকে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছি। অনেকের সঙ্গে ৩০ বছর পর দেখা হলো। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। আশা করি, ভবিষ্যতেও এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতা থাকবে।’

প্রাক্তন শিক্ষক ও পারখিদিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন, ‘আমরা খুশি ও গর্বিত আমার প্রিয় ছাত্রদের জন্য। তারা আজ আমাদের যে সম্মান দিল তা আজীবন স্মৃতিতে গাঁথা থাকবে। আমার ভালো লাগা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। খুবই খুশি হয়েছি। দোয়া করি, সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো ও সুস্থ থাকুক। কর্মস্থলে আরও উন্নতি হোক।’

সাবেক প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আলজাজ্ব ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের সময় পালিয়ে বেরিয়েছি। স্বাধীনের পর তৎকালীন এমপি সমাজী সাহেব আমাদের একটি বিল্ডিং করে দেন। যেটা ছিল আমার অফিস রুম। আর স্কুলের জন্য জায়গা কিনে দিলেন। সেই কষ্টের দিনগুলো নানা চড়াই-উৎড়াই পার করে শিক্ষকদের পরিশ্রমে আজ এতদূর এসেছে স্কুলটি। এতদিন পর সবাইকে একসঙ্গে দেখে আমার খুবই আনন্দ লাগছে।’

পরে প্রয়াত শিক্ষক-কর্মচারীদের মরণোত্তর সম্মাননা স্মারক, প্রাক্তন শিক্ষক, প্রাক্তন কর্মচারী, কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়৷ পরে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় র‌্যাফেল ড্র ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ১৯৯৩ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কামাল হোসেন ও ১৯৯৪ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আব্দুল কুদ্দুস।