বরগুনার আমতলীতে ভেঙে পড়া ‘হলদিয়াহাট সেতু’ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো ঠিকাদারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন। উপজেলা প্রকৌশলী এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে দুই কোটি টাকা বাজেটে সেতু নির্মাণের কাজ পান তৎকালীন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও হলদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম। কিন্তু, শুরু থেকেই ঠিকাদার ও এলজিইডি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সেতু নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। ফলস্বরূপ পাঁচ বছরের মধ্যে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
হলদিয়াহাট সেতু সংলগ্ন ব্যবসায়ী শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘নিম্নমান এবং পরিমাণে কম সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই দেন ঠিকাদার। সেতুর নিচে যে লোহার পাত ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ছিল পুরাতন। সে সময় এলজিইডি র কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসলে আমরা অভিযোগ করি। কিন্তু, তারা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের কাছে আমাদের নাম বলে দেয়। এরপর শহিদুল ইসলাম সেতু নির্মাণ কাজে বাধা দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে আমাদের নামে মামলার হুমকি দেন। পরে আমরা আর কিছু বলিনি। সে তার মতো কাজ করে গেছেন। নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় সেতুটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সে সময় একটি অটোরিকশা গেলেও এটি কেঁপে উঠত।’
হলদিয়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেতু নির্মাণে শুরু থেকেই অনিয়ম করেছেন ঠিকাদার। এলজিইডির কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে তখন নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন। এই খালের ওপর আরও পাঁচটি সেতু আছে। সবগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এই সবগুলো সেতু নির্মাণ করেছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম। এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।’
একই এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা, ইউসুফ হায়দার, জহিরুল ইসলাম বলেন, এই দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদার ও এলজিইডি কোনোভাবে এড়াতে পারে না। সেতু নির্মাণে লুটপাট না করে সঠিকভাবে কাজ করলে এবং এলজিইডি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তদারকি করলে এই প্রাণহানি হতো না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ঠিকাদার শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। তবে, তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হলদিয়াহাট সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করায় এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এছাড়া, আমতলী দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালের জলোচ্ছ্বাসে হলদিয়া সেতু পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে মনে হচ্ছে। তৎকালীন ঠিকাদার সঠিকভাবে কাজ করেছেন। আর সে সময় এলজিইডির যেসব কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারাও সঠিকভাবে তদারকি করেছেন।’
হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মিন্টু মল্লিক বলেন, ‘হলদিয়া খালটি সুবন্ধি নদীর সঙ্গে যুক্ত। ভাঙনরোধে ২০০৯ সালে সুবন্ধি নদীতে বাঁধ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপর থেকে সুবন্ধিতে জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে বদ্ধ নদীতে পরিণত হয়েছে। মরে গেছে নদীর সঙ্গে যুক্ত ১৭টি খাল। এই মরা খালে ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৌশলীর এমন মন্তব্য দায়সারা ও ঠিকাদারের পক্ষ নেওয়ায় সামিল।’
এ বিষয়ে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, ‘দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসককে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছি । তিনি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার আগে উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী এমন মন্তব্য করতে পারেন না। তাকে ডাকা হবে, তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে উনি এমন মন্তব্য কেন করেছেন জানতে চাওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত শনিবার (২২ জুন) দুপুরে বরগুনার আমতলী উপজেলায় সেতু ভেঙে বিয়ের যাত্রী নিয়ে একটি মাইক্রোবাস খালে পড়ে যায়। পরে ওই মাইক্রোবাসে থাকা ৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
আরও পড়ুন
বিয়ে বাড়িতে লাশের মিছিল, শোকে আনন্দ ম্লান
সেতু ভেঙে ৯ জনের মৃত্যু: ঠিকাদারের শাস্তি দাবিতে বিক্ষোভ
বিয়ের যাত্রী নিয়ে সেতু ভেঙে মাইক্রোবাস খালে, নিহত ৯