জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী ইউনিয়নের ‘পুন্ডুরিয়া’ এখন পাখিদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ওই গ্রামের ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্তত ২০০টি উঁচু গাছ এবং বাঁশঝাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো পাখির বসবাস। গ্রামবাসী পাখিগুলোকে পরম মমতায় আগলে রাখলেও ইদানিং বিরক্ত হয়ে তাড়াতে শুরু করেছেন।
তাদের অভিযোগ, পাখি বাসা করায় গাছ, পুকুরের মাছ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে পাখিগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল রক্ষণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও মিলেনি কোন প্রতিকার। সরকারিভাবে জনসাধারণের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই পাখি কলোনি সংরক্ষণ করার দাবি স্থানীয়দের।
তাছাড়া কৃষি জমিতে অবাধে কীটনাশক প্রয়োগের প্রভাবে খাদ্য সংকটে দিন দিন কমছে পাখির সংখ্যা।
বন অধিদপ্তরের একটি জরিপে দেখা গেছে, অন্যান্য পাখি কলোনির মতোই পুন্ডুরিয়া পাখি কলোনিও হুমকিতে আছে। এখনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে পুন্ডুরিয়ার পাখিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন পাখিবিদরা।
পুন্ডুরিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রশিদের পুকুর পাড়ের বড় বড় গাছের মগডালে হাজারো শামুকখোল পাখি বাসা বেঁধেছে। সেখানে প্রায় ২০০টি উঁচু গাছ এবং বাঁশঝাড়ে হাজারো পাখির বাসা রয়েছে। সেখানেই তারা বাচ্চা দিচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে প্রজননও করছে তারা।
স্থানীয়রা জানান, ৫০ থেকে ৬০ বছর থেকে ওই গ্রামে রাতচোরা, পানকৌড়ি, হাইতোলা ও হারগিলা নামক পাখিগুলো আসা যাওয়া করে। প্রথমে সংখ্যায় কম হলেও দিন দিন বৃদ্ধি পায় তাদের সংখ্যা। প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরু থেকে বর্ষা এবং শরৎকাল পর্যন্ত তারা এখানে থেকে বংশ বৃদ্ধি করে। আবার হেমন্তের শুরুর দিকে চলে যায়। এভাবেই ঋতুর পরিক্রমায় এই এলাকায় তাদের বিচরণ দীর্ঘ দিনের।
গ্রামের চার পাশের খাল-বিল আর ফসলের মাঠ থেকে খাবার খুঁজে খায় পাখিগুলো। কৃষি জমিতে অবাধে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ বিলুপ্তির পথে। এতে সংকট দেখা দিয়েছে পাখিদের খাবারের। এর কারণে পাখির সংখ্যাও কমছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তাছাড়া পাখিগুলো সংরক্ষণে সরকারের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। গ্রামবাসীরা নিজ উদ্যোগেই আগলে রেখেছেন পাখিদের। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই গ্রামটি গুরুত্বপূর্ণ পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিণত হবে বলে জানান গ্রামবাসী।
ওই গ্রামের বাসিন্দা বুলবুল আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, পাখিগুলো আমাদের গ্রামে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলায় গ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে আমাদের গাছ, পুকুরের মাছ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করছে। আমরা সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বন অধিদপ্তরে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। আমরা চাই এই গ্রামে পাখি থাকুক। পাখি পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারিভাবে আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করলে এই কলোনি আরও সমৃদ্ধ হবে।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের প্রধান গবেষক শিবলী সাদিক জানান, বন অধিদপ্তর গত ২০২২ ও ২০২৩ সালে পাখি কলোনি সংক্রান্ত একটি গবেষণা ও জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এর নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। উক্ত কার্যক্রমটি উত্তরবঙ্গের ১৬ টি জেলাসহ ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের আটটি জেলায় পরিচালিত হয়। দেখা গেছে, পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থলের অভাবে দিন দিন এদের সংখ্যা হুমকির দিকে। বেশির ভাগ কলোনিই এখন হুমকির মধ্যে আছে এমন তথ্যই উঠে এসেছে তার গবেষণায়। তার মধ্যে আক্কেলপুরের পুন্ডুরিয়া কলোনিও রয়েছে। এই কলোনিগুলো পাখি সংরক্ষণের বড় এলাকা। যেহেতু ব্যক্তি মালিকানাভুক্ত বাগান এবং গাছে পাখিরা আশ্রয় নিয়েছে সেহেতু ওইসব ফলদ গাছে ফল হবে না। বাগান মালিকদের ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা করতে হবে। বিধায় এখনই সরকারের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে এসে মালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে সরকারিভাবে পাখিগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে হবে। তবে কোনোভাবেই বাগানমালিকদের কাছ থেকে জায়গাটুকু নেওয়া যাবে না।
বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ গবেষণা নিয়ে কাজ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, এগুলো সারস প্রকৃতির বড় পাখি। মূলত এরা মাছ, শামুক, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ ও বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। বর্ষা মৌসুমে খাল বিল পাখির খাদ্যের উৎস। খাবারকে কেন্দ্র করে তারা দল বেঁধে বসবাস করে। কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে খাবার সংকটে বিপন্ন হতে পারে পাখিগুলো। এখনি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুরুল আলম বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। পাখিদের রক্ষার্থে প্রাণী সম্পদ, পরিবেশ এবং বন বিভাগকে সাথে নিয়ে কাজ করা হবে। পাখিগুলো যেন বিপন্ন না হয় সে বিষয়ে কলোনি রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদের ভাষ্য, প্রাকৃতিক ক্ষতির বিষয়ে আমরা কোন অভিযোগ পাইনি। তবে আক্কেলপুরের পুন্ডুরিয়া পাখি কলোনি আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করা হবে। সরকারিভাবে প্রণোদনার আওতায় নিয়ে এসে সার্বিক বিবেচনায় জনসাধারণের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে কৃষি দপ্তর বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের পরিমিত আকারে কীটনাশক প্রয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন সুপরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া পার্চিং পদ্ধতিসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।