অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে লক্ষ্মীপুরের অধিকাংশ আমনের বীজতলা নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন জলবদ্ধতা থাকায় পচে নষ্ট হচ্ছে এসব আমন বীজতলা। এতে চলতি মৌসুমে আমন ধানের আবাদ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এখানকার প্রান্তিক কৃষকরা।
তবে এ ক্ষতি আমন আবাদে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে দাবী কৃষি বিভাগের। স্বল্প সময়ে উন্নত জাতের বীজতলা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরায় আমনের রোপণের উপযোগী চারা পাওয়া সম্ভব বলে জানান তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে জেলার ৩১ হাজার ৯৫ কৃষকের আমনের বীজতলা পানিতে পচে নষ্ট হয়েছে। এতে অন্তত ১৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ বছর জেলার ৫টি উপজেলায় ৫ হাজার ১২১ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা করেছেন চাষিরা। অতি বৃষ্টিপাতের প্রভাবে ১ হাজার ৯৪১ হেক্টর আমন বীজতলা বৃষ্টিরপানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৩২০.৫১ হেক্টর আমন বীজতলা সম্পুর্ণরূপে পচে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমান ২৫.৭৯ % বলে জানানো হয়।
তাছাড়া চলতি বছর রোপা আমনের আবাদ করা হয়েছে ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে ৮.৪৪ হেক্টর জমির ফসল বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। আউশের আবাদ হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে। বৃষ্টিতে ৫৭২.৭ হেক্টর জমির আউশের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে।
কৃষকরা জানায়, চলতি মাসে প্রায় প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশের পুকুর, খাল-বিল নালা বৃষ্টির পানিতে ভরাট হয়ে আছে। এতে অধিকাংশ চারাগাছই পচে গেছে। নতুন করে বীজতলা তৈরির সময় না থাকায় এবারের আমনের আবাদ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আষাঢ় মাসের শুরুতে আমনের বীজতলা তৈরি করেন এ অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক। আষাঢ় শেষে অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের শুরুতে বীজতলা থেকে আমনের চারা গাছ তুলে রোপণ করেন তারা। কিন্তু শ্রাবণ শেষ হয়ে গেলেও সে সুযোগ হয়নি তাদের। জলবদ্ধতার কারণে বীজতলা পচে যাচ্ছে। চাষিরা উপায় না পেয়ে চারাগাছের পচা অংশ তুলে ফেলছেন। এতে একেকজন কৃষকের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুর সদরের চর রুহিতা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও স্থানীয় কৃষক মো. সেলিম পাটোয়ারী জানান, এ ইউনিয়নের শুধুমাত্র (৭নং ওয়ার্ডস্থ) দহশালা চর রুহিতা মৌজা ও মৌজা নদী নামের এ দুই গ্রামেই দুই শতাধিক কৃষক প্রায় আড়াইশ একর জমিতে প্রতি বছর ইরি, বোরা ও আমন ধানের আবাদ করে থাকে। তাদের প্রধান পেশা কৃষি। এবারও সময় মত আমনের বীজ তলা করেন চাষিরা। বৃষ্টি তাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। হাটুপানিতে ডুবে আছে অধিকাংশ কৃষকের বীজতলা। চারদিকের নদী-খাল-বিল ও পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়ায় বীজ তলার পানি না সরায় পচে নষ্ট হয়ে গেছে এসব বীজতলার চারাগাছ।
তিনি আরো জানান, প্রতি ৬ শতাংশ জমিতে বোপণের জন্য ১ কেজি পরিমাণ আমন বীজ তথা চারা প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে এ দুই গ্রামের আড়াইশ একর জমির জন্য প্রায় ৪ হাজার ১৬৬ কেজি বীজ প্রয়োজন। যার পুরো বীজতলাই এখন পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে।
এ দুই গ্রামের আমনের আবাদ করে বছরে বিঘা প্রতি (৩৩ শতাংশ) জমিতে ১০ মন হারে আড়াইশ একর জমিতে প্রায় ৩ হাজার ৩০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। এ অঞ্চলের মানুষ ধার-দেনা করে কৃষি কাজ করে থাকে। বৃষ্টির পানিতে বীজতলা হারিয়ে আমন চাষ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দহশালা চররুহিতা ও মৌজা নদী গ্রামের বিস্তৃর্ণ ফসলি মাঠ বৃষ্টির ডুবে আছে। বীজতলাগুলোও জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। কৃষকরা পচা চারাগাছ গুলো বেচে বেচে পানি থেকে তুলে ক্ষেতের পাড়েই উচু স্থানে পেলছে। বীজ তলার কিছু চারাগাছ বাঁচানো যায় কিনা সে আসায়, কিন্তু পানি না সরায় সে অংশটুকুও টেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এসময় বীজতলার পাশেই বসে তিনজন কৃষককে আফসোস করতে দেখা যায়। একই পরিস্থিতি জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি, কমলনগর ও সদর উপজেলার আমনের বীজতলার। মৌজা নদী গ্রামের কৃষক মফিজুর রহমান, কৃষক শামছুল ইসলাম মিডাই, কৃষক নুর মোহাম্মদ- এরা সবাই বীজতলা নষ্ট হওয়ার দুঃখের কথা শোনালেন।
রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জ এলাকার সোহাগ হোসেন ও কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট এলাকার অজি উল্যাহ জানালেন, নির্ধারিত সময়ে বীজতলা করেও বৃষ্টিতে আজ সব শেষ। কৃষি বিভাগ থেকে আমনের চারার ব্যবস্থা করা হলে হয়তো দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা রক্ষা পেতেন তারা।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দীন ফিরোজ বলেন, এখনো প্রতিদিনই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে এ ক্ষতি আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় প্রভাব ফেলবে না। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতি নিরুপণ করা হয়েছে। পানি নেমে গেলে চারাগাছ ঠিক হবে। চলতি মৌসুমে আমনের চাহিদার তুলনায় ১১৫% বেশি বীজতলা করা হয়েছে। এতে ক্ষতি ১৫ % এর বেশি হবে না।
তিনি বলেন, কৃষকরা যেন বিপদে না পড়ে এজন্য ফেনী কৃষি ইনিস্টিটিউটের সাথে কথা হয়েছে। তারা উন্নত জাতের বীজ পাঠালে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ ও ডিলারদের থেকে সংগ্রহ করতে পারবে কৃষকরা। তবে ক্ষেতের পানি সরার সাথে সাথে কৃষকরা নিজেরাই কমিউনিটির মাধ্যমে বীজ তলা করে চারা করে। পরে নিজেদের জমিতে আবাদ করে। এতে কৃষক এ ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে।
জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, লক্ষ্মীপুর একটি কৃষি নির্ভর জেলা। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে আমনের বীজতলাসহ কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি রামগতি, কমলনগর, রামগঞ্জ, রায়পুরসহ সদর উপজেলার নিবাহী অফিসারগণ জানিয়েছেন। তবে ক্ষতির প্রতিবেদন কৃষি বিভাগ থেকে এখনো হাতে আসেনি। প্রতিবেদনটি হাতে পেলে সহযোগিতার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
প্রসঙ্গত: চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় ৮৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬৯৮ মেট্রিক টন।