সারা বাংলা

ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভেঙে ফেলার তদন্ত প্রতিবেদনে যা উঠে এলো

কালজয়ী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক বাড়ি ভেঙে ফেলার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মহিনুল হাসান বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের কাছে তাঁর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। 

ওই প্রতিবেদনে তিনি জমির যে অংশে ঋত্বিকের পৈতৃক বাড়িটি ছিল সে স্থানটির মালিকানা ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটিকে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

রাজশাহী নগরের মিয়াপাড়া এলাকার এই পৈতৃক বাড়িতে ঋত্বিক ঘটকের শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের সময় কেটেছে। বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়। এরপর জায়গাটির উত্তরে গড়ে তোলা হয়েছে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের ভবন। এ ভবনের দক্ষিণ অংশে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত পুরোনো বাড়ির ঘরগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িটি অপসারণ করে সেখানে অন্য স্থাপনা করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই করছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

সারাদেশে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ডামাডোলের মধ্যে গত ৬ ও ৭ আগস্ট ঋত্বিকের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৪ আগস্ট বিষয়টি জানতে পেরে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা কলেজে ছুটে যান এবং বাড়ি ভাঙার পেছনে কর্তৃপক্ষের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নেন।

তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা হিসেবে দাবি করা ভবনটি ভাঙার জন্য গত ৬ আগস্ট সন্ধ্যার পর একদল লোক হাতুড়ি, শাবল নিয়ে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজের ভেতরে আক্রমণ করে এবং তারা ভবনটির উত্তর পাশের পুরো ওয়াল, দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারের আংশিক ওয়াল ভেঙে ফেলে। সে সময় কলেজের নৈশপ্রহরী মাহফুজ উর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তিনি কাউকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন। কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আনিসুর রহমান ফোনে বিষয়টি অবগত হওয়ার পর ঘটনাস্থলে যান এবং যারা ভবন ভাঙছিলেন তারা তখন চলে যান। অধ্যক্ষও কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি বলে দাবি করেছেন। কলেজের সিসিটিভি ক্যামেরা গত ৬ আগস্ট দুপুর ১২ টা ৪৭ মিনিটের পর থেকে বন্ধ থাকায় ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করার জন্য ৭ আগস্ট দুপুরে অধ্যক্ষ মিস্ত্রী শামীম মিয়াকে রাস্তায় পড়ে থাকা ভবনের ভাঙা আবর্জনা পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী মিস্ত্রী ছয়জন শ্রমিক নিয়ে ভবনের ভাঙা ইট ও আবর্জনা একটি জায়গায় স্তুপ করেন। ঝুলে পড়া টিন ধরে টান দিলে ভবনের বাকি তিন পাশের ওয়াল ভেঙে পড়তে শুরু করে। পরবর্তীতে মিস্ত্রিরা একপাশের তিন ফুট ওয়াল রেখে অবশিষ্ট ওয়াল ভেঙে এক জায়গায় স্তুপকারে রাখেন। ঘটনার এই অংশে বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বসতভিটার অবশিষ্ট অংশ সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ঝুঁকি বিবেচনায় ভবনটির অবশিষ্টাংশ ভেঙে স্তুপ করে রাখা হয়। এতে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রমাণিত হয়।’

প্রতিবেদনে জায়গাকে কেন্দ্র করে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির টানাপোড়েনের বিষয়টিও উঠে আসে। বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি বিজড়িত পৈতৃক বসতভিটা সংরক্ষণ এবং প্রতিবছর ৪ নভেম্বর এখানে জন্ম দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও ঋত্বিক সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি ও হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে টানাপোড়ন চলছিল। একদিকে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি বিজড়িত বসতভিটা, অন্যদিকে জায়গাটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের রেকর্ডিয় মালিকানাধীন। পরস্পর বিরোধী এই অবস্থানের কারণে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি অবহেলিত রয়েছে।’

তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর সুপারিশে বলেছেন, ‘ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী; তথা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে তরুণ প্রজন্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং তাঁর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা সকলের দায়িত্ব। তাই রাজশাহী হোমিওপ্যাথি কলেজের অভ্যন্তরে অবস্থিত ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি স্থায়ীভাবে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির নামে মালিকানা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।’

তিনি আরও বলেছেন, ওস্থায়ী মালিকানা না পাওয়া পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ফিল্ম সোসাইটি নির্বিঘ্নে জায়গাটি ব্যবহার করবে। আগামী ৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বরাবরের মত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি প্রস্তুত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তদন্ত কর্মকর্তা সেখানে একটি ‘ঋত্বিক মঞ্চ ও ঋত্বিক সংরক্ষাণাগার’ দ্রুত নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছেন। প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।