ঢাকার উত্তরায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন সোমা আক্তার। নানা সঙ্কটে পাওনা না মিটিয়েই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বকেয়া পাওনাদির দাবিতে কারখানায় আন্দোলনে নামে শ্রমিকরা। দাবি মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ। মধ্যস্থতা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ফের কারখানা চালু হলে পুরনো শ্রমিকরা সুযোগ পাবেন। কয়েক মাসের মধ্যে কারখানা চালু হয়, তবে চাকরি পাননি তারা। চেষ্টা করেন অন্য কারখানায় চাকরির। সেখানে সাক্ষাৎকারের পর প্রাথমিকভাবে আশ্বাস পেলেও শেষপর্যন্ত চাকরি হয়নি।
এই নারী শ্রমিকের ভাষ্য, নতুন কারখানায় আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ চাকরিতে নেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়। সঙ্গে পূর্বের কারখানায় আন্দোলন করেছিলেন সেটিও উল্লেখ করেন। জানিয়ে দেয়, ‘আগের কারখানায় আন্দোলন করায় কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন তিনি।’ এরপর আরও কয়েকটি কারখানায় গিয়ে একইভাবে চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এই শ্রমিক।
শুধু সোমা আক্তার নন, আন্দোলন করায় ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হয়ে নতুন করে কোনো পোশাক কারখানায় চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন আরও অনেক শ্রমিকই। এটিকে নিপীড়ন বলে উল্লেখ করেছেন শ্রমিকরা।
২০২১ সালে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছিল, পোশাক শ্রমিকদের জন্য বায়োমেট্রিক আইডেনটিটি অ্যান্ড ওয়ার্কাস ইনফরমেশন সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। এই তথ্যভাণ্ডারে শ্রমিকদের আঙুলের ছাপসহ তাদের পরিচয়, রক্তের গ্রুপ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নানা তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, জাতীয় নীতিনির্ধারণ, মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কত শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত, তা নির্ণয় এসবের জন্য তথ্যভাণ্ডর করা জরুরি। এ ছাড়া এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় গেলে শ্রমিকদের দক্ষতার বিষয়টিও এই তথ্যভাণ্ডারের মাধ্যমে জানা যায়। তাই এই তথ্যভাণ্ডার করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। তবে এটির ব্যবহার যেভাবে হচ্ছে, তা স্পষ্টত মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
একইভাবে শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের সুবিধার্থে গঠন করা এ তালিকা এখন শ্রমিকদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যা শ্রম আইনের নীতি বহির্ভূত।
তাদের দাবি, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) অধীনে থাকা কারখানাগুলো সম্মিলিতভাবে শ্রমিকদের তালিকা প্রস্তুত ও তাদের তথ্য ভাগাভাগি করছে। সেই অনুযায়ী কোনো কারখানায় কোনো শ্রমিক কোনো অভিযোগে চাকরিচ্যুত হলে সেই তথ্য বিজিএমইএ তথ্যভাণ্ডারে নথিভুক্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট শ্রমিক বিজিএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানায় চাকরির জন্য গেলে চাকরিচ্যুত শ্রমিকের তথ্য কর্তৃপক্ষ পেয়ে যায় ও চাকরি দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
ঢাকার ‘চৈতি ফ্যাশন’ নামে একটি কারখানায় কর্মরত ছিলেন জাহানারা বেগম নামে এক নারী শ্রমিক। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। তিনি ওই কারখানার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
তিনি জানান, পাওনাদি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন তিনিসহ কারখানার শ্রমিকরা। তাদের পাওনাদি মিটিয়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় পরবর্তীতে কারখানা চালু হলে ফের চাকরি পাবেন। কিন্তু কারখানা চালু হলেও চাকরি ফিরে পাননি তিনি।
জাহানারা বেগম বলেন, ‘ওই কারখানায় চাকরি হারানোর পর আশপাশের অন্তত পাঁচটি কারখানায় চাকরির চেষ্টা করেছি। ইন্টারভিউ হয়ে যায়, আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর তারা আগের কারখানার ঘটনা বলে জানিয়ে দেয়, চাকরি দিতে পারবে না। আমার মতো এমন আরও অনেকেই এরকম চাকরি পাচ্ছেন না। দক্ষ শ্রমিক হয়েও তারা এখন পোশাক কারখানার চাকরি পাচ্ছেন না। কেউ কেউ অন্য পেশায় ঢুকে পড়েছেন। ছেলেরা কেউ কেউ রিকশা চালানোর পেশায় ঢুকেছেন।’
আল আমিন নামে অপর এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি নিপা গ্রুপে আট বছর চাকরি করছি। তারপর ছয় বছর আ্যাচিভ ফ্যাশনে চাকরি করি। এরপরে কারখানা বন্ধ হলে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যাই। এরপর ওলিও গার্মেন্টসে চাকরি নিতে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিছি, তখন আমাকে চাকরিতে না করে দিছে। বলেছে, নিপা কারখানা আমার নামে নেগেটিভ দিছে। চাকরি হয়নি। সেখানে গেছি তারা বলে ভুলে হয়েছে। তারপর তারা আমাকে একটা কাগজে লিখে দিল যে ভুলে এটা হয়েছে। কিন্তু আমি আর চাকরি পাইনি।’
চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আবুল কালাম বলেন, ‘মূলত আমরা দেখি যদি বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানা হয়, সেক্ষেত্রে অনলাইনে একটা আঙুলের ছাপ থাকে। সেটি দেখলে বোঝা যায়, উনি কোন কারখানায় ছিলেন, কোন পদে ছিলেন, কবে জয়েন করেছেন, কতদিন পর চাকরি ছেড়েছেন। আবার যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, সেখানে অনলাইনে যদি তার পোর্টালে লিখে দেয় সে অপরাধী বা কী কী অপরাধ করেছে, ওটাও থাকে। আমরা সেটাই প্রাধান্য দেই। বেশিরভাগ আমরা অভিজ্ঞতায় গুরুত্ব দেই। বিজিএমইএ-এর কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার আমরা অনুসরণ করি।’
এটি আইনসিদ্ধ কিনা সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সব কারখানায় শ্রম আইন মেনে আমরা নিয়োগ দেই।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন পোশাক কারখানা মালিক এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘বিজিএমইএ এর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, শ্রমিকরা কারখানায় কোনো দাবি উত্থাপন বা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে গেলে তাদের চাকুরিচ্যুত করা হচ্ছে। চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের ছবিসহ নামের তালিকা কারখানার গেইটসহ বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই শ্রমিকরা যেন অন্য কারখানায় চাকরি করতে না পারে, সেজন্য বিজিএমইএ-এর শ্রমিক তথ্যভাণ্ডারে শ্রমিকদের নামে নেতিবাচক বক্তব্য লিখে রাখছে। শ্রমিকরা অন্য কারখানায় চাকরি নিতে গেলে কারখানার মালিকপক্ষ শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে বিজিএমইএ তথ্যভাণ্ডারের সাথে মিলাতে গিয়ে শ্রমিকদের নামে নেতিবাচক বক্তব্য থাকলে তাকে আর চাকরি দেন না। এটা একটা অমানবিক নিষ্ঠুর কাজ। এই ধরনের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
সম্মিলিত শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাহিদুল হাসান নয়ন বলেন, ‘পোশাক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা জানতে এই তথ্যভাণ্ডার করার কথা ছিল নিরপেক্ষভাবে। কিন্তু এটি পরবর্তীতে বিজিএমইএ-এর কাছে দেওয়া হলো। এই তালিকায় চাকরি সমাপ্তির পয়েন্ট আছে, সেখানে কোনো শ্রমিকের নেতিবাচক তথ্য দেওয়া থাকলে, বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানায় তারা চাকরি পান না। এটা মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকারের লঙ্ঘন। আমরা এই তালিকা নিরপেক্ষ কোনো সংস্থার কাছে দেওয়ার দাবি জানাই ও এই তালিকা থেকে শ্রমিকদের চাকরিতে সমস্যা হয় এমন তথ্য প্রদান দেওয়া বাতিল করতে হবে।’
বিলস-এর নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রানা প্লাজার ঘটনার পর শ্রমিক সংখ্যা ও কারখানার তথ্য জানতে এই আলোচনাটি উঠেছিল। কিন্তু সেটি প্রকাশ করা হয়নি। কালো তালিকাভুক্তির বিষয়ে অনেক অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। এটি স্পষ্টত মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা বিজিএমইএ-কে জানিয়েছি যেন এটা অবশ্যই বন্ধ করা হয়। এর মাধ্যমে শ্রমিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। কারখানাগুলোও দক্ষ শ্রমিক হারাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে কোনো কারখানা কোনো শ্রমিকের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে তার নামে নেতিবাচক প্রতিবেদন দিলে সে আর কোনো কারখানায় চাকরি পাচ্ছে না। কোনো কারখানা চাইলেও নিতে পারে না। ফলে শ্রমিক যেমন কাজ হারিয়ে বিপদে পড়ছে, তেমনই পোশাক শিল্প একজন দক্ষ শ্রমিক হারাচ্ছে। এটা অন্যায়। কোনো শ্রমিক অসন্তুষ্ট হলে সে যদি প্রতিবাদ করে, সেটি তার আইনি অধিকার। তার নামে মামলা বা অভিযোগ হলে সেটাও পদ্ধতি আছে। সার্ভিস বুকে সেটি উল্লেখিত থাকতে পারে। তারপরও যদি কোনো কারখানা চাকরি দিতে চায়, সেটিও তার অধিকার আছে। কিছু দিন আগেও বিজিএমইএ ও ইউনিয়ন নেতাদের বৈঠকে বিষয়টি উঠে এসেছিল। প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি।’
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা তুলে ধরে। সংস্থার সিনিয়র স্টাফ আইনজীবী সিফাত-ই-নূর খানম বলেন, ‘এই বিষয়টি মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকারের লঙ্ঘন। সুস্পষ্টভাবে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তথ্য প্রমাণ মিললে জনস্বার্থে মামলার সুযোগ রয়েছে। আমরা শ্রমিকদের আহ্বান জানিয়েছি যাতে তারা তথ্য দেন।’
বিজিএমইএ-এর সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘‘এরকম কোনো আইন বা নীতি তাদের সেক্টরে নেই, বা লেবার ল তেও এমন কোনো ধারা নেই। তবে অনেক আগে একটি সিদ্ধান্ত ছিলো- কোনো শ্রমিক বা কর্মচারী কেউ যদি ক্রিমিনাল অফেন্সের সাথে জড়িত থাকে- যেমন নারী নিপীড়ন, ষড়যন্ত্র, চুরি এবং তা যদি লিগ্যালি প্রমাণিত হয়, তবে রিজিওনাল ফ্যাক্টরিগুলোতে তার তথ্য সরবরাহ করা যাবে। যেন এই ধরনের কর্মকাণ্ড সে করার সুযোগ আর না পায়।
‘তবে প্রতিবাদ বা আন্দোলনে জড়িত কারও বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এমনকি এই আঞ্চলিক সিদ্ধান্তটিও কেউ এখন মানতে পারছে না। কারণ সম্প্রতি শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন প্রমাণিত ব্যাপারগুলোকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কেউই এটা এখন আর স্ট্রিক্টলি মানছে না।
‘আর যেহেতু লেবার ল বা আমাদের কোনো ধারাতেও এমন কোনো আইন বা অধ্যাদেশ নেই, তাই এইটা মানার ব্যাপারেও কারো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় এইচআর এসব না দেখেই নিয়োগ দিচ্ছে।’’