সারা বাংলা

ভ্যানের ওপর লাশের স্তূপের ভিডিওটি আশুলিয়া থানার

একটি ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে একাধিক মরদেহ। পুলিশের জ্যাকেট পরা দুই ব্যক্তি আরও একটি মরদেহ চ্যাং-দোলা করে ভ্যানের ওপর ছুঁড়ে মারেন। আশপাশে উপস্থিত কয়েকজন পোশাক পরিহিত পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। 

গতকাল শুক্রবার (৩০ আগস্ট) থেকে এমন দৃশ্যের ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওর সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিডিওটির ঘটনাস্থল ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইলে আশুলিয়া থানার সংলগ্ন এলাকায়।

শনিবার (৩১ আগস্ট) সকালে আশুলিয়া থানা সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে ভিডিওর ঘটনাস্থলটির সত্যতা মেলে। স্থানীয়রা নিশ্চিত করছেন, ভিডিওর ঘটনাস্থল থানার সামনের সড়কে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই ভিডিওটি আশুলিয়া থানা ভবনের পার্শ্ববর্তী ভবন থেকে ধারণ করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ভিডিওর প্রথম ২০ সেকেন্ড সড়কে একটি নিথর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ২০ সেকেন্ডের দিকে পাশেই একটি ভ্যানে আরও একাধিক মরদেহ স্তুপ করে রাখা হয়েছে।

একটি মরদেহের মুখে রক্তমাখা দেখা যায়। দুইটি মরদেহের হাত ছিল ছড়িয়ে রাখা। মরদেহগুলো বিছানার চাদর সদৃশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ছিল। পাশে অস্ত্রধারী দুই পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ৩৫ সেকেন্ডের দিকে সড়কে পড়ে থাকা মরদেহটি চ্যাংদোলা করে তুলতে দেখা যায় পুলিশের জ্যাকেট পরা দুই পুলিশ সদস্যকে। ৫৬ সেকেন্ডের দিকে দুই ব্যক্তির হেঁটে যাওয়া দেখা যায়। ১ মিনিটের পরে আশপাশে আরও দুই ব্যক্তিকে দেখা যায়। একজনের হাতে অস্ত্র, আরেকজনের হাতে হেলমেট ছিল। 

১ মিনিট ১৩ সেকেন্ডে দুই ব্যক্তি মরদেহগুলোর ওপরে একটি পিবিসি ব্যানার দিয়ে দেন। এর দুই সেকেন্ড পরই দুই ব্যক্তিকে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে দেখা যায়। পাশে ভ্যানের ওপর স্তুপ করে রাখা ছিল মরদেহগুলো। 

১ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের দিকে পাশে ৬-৭ জন পুলিশ সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে তৈরি করা বাংকার। বাংকারের ঠিক পেছনে একটি হলুদ রংয়ের দেয়াল, নিচে কালো রং করা। দেয়ালের প্রায় ৩ ফুট ওপরে একটি পোস্টার সাঁটানো। দেয়ালের পাশে অসংখ্য জুতা। পুলিশ সদস্যরা ওই সময় আশপাশে নজর রাখছেন দেখা যায়। একজনকে ফোন কানে নিতেও দেখা যায়। 

মূলত দেয়াল ও দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারের সূত্র ধরেই শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এটি আশুলিয়া থানার সংলগ্ন ‘ইসলাম পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টার’ এর সীমানা দেয়াল।

ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যায়, সেটি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী মো. আবুল হোসেন ভূঁইয়ার। তবে বালুর বাংকার এরইমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেয়ালটিতে এখনও পোস্টারটি সাঁটানো রয়েছে।

পরে ঘটনাস্থল চিহ্নিত করতে আজ সকালে আশুলিয়া থানার সামনে যান স্থানীয় সাংবাদিকরা। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আশুলিয়া প্রেসক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানা রোড অতিক্রম করে এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের দেয়ালটি হুবহু ভিডিওতে দেখানো ঘটনাস্থলের সাথে মিলে যায়। ওখানে এখনও সেই পোস্টারটি দেয়ালে এখনো সাঁটানো রয়েছে।

থানা সংলগ্ন একাধিক দোকানদার ভিডিওতে দেখা যাওয়া দেয়াল, পুলিশের বাংকার ও স্থানটি থানা সংলগ্ন বলে নিশ্চিত করেন। 

বাংকারের অপর পাশে থাকা সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি এন্ড মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোকানি ফাহিমা বেগম বলেন, ‘ভিডিওর যে জায়গাটি, এটি আমার দোকানের সামনের।’ পাশেই ভ্যানে সবজি বিক্রি করা বিল্লাল হোসেনও তা নিশ্চিত করেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সকাল থেকে আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল মোড়ের দিকে জড়ো হন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা। এ সময় সেখানে দিনভর সংঘর্ষ চলতে থাকে। বিকেলের দিকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করে এমন খবর পাওয়ার পরপরই আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে থানার দিকে আসে। 

মিছিলকারীদের আসার খবরে মসজিদের মাইক ও হ্যান্ড মাইক দিয়ে থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। এরপরও আন্দোলনকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। সেই মরদেহগুলোই হয়তো ভ্যানে তোলা হয়ে থাকতে পারে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে থাকা পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজনকে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক আরাফাতের মতো বলে চিহ্নিত করা গেছে বলে জানা যায়। ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ছবিটি আরাফাতের বলে নিশ্চিত করেন। তবে ডিবির কোনো সদস্য গুলি করেনি বলে দাবি করেন তিনি।

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ বলেন, ‘আমরা সাইবার ক্রাইমে দিয়েছি ভিডিওটি সনাক্ত করণের জন্য। আমরা দেখছি। আমাদের কাছেও ছবিটি এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে আমরা কাজ করছি। বিষয়টি নিশ্চিত হলে আইনগতভাবে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নেওয়া হবে।’

গত ৫ আগস্ট সাভারে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে অন্তত ৩১ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এছাড়া গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ওই দিনের ঘটনায় অন্তত ৪৫ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ আরও অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। 

ওই দিন তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এরমধ্যে দুইজনকে হত্যার পর নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইলের একটি ওভারব্রিজের ওপর উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এক পুলিশ সদস্যের পোড়ানো মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া থানা সংলগ্ন এলাকায় একটি পুলিশ ভ্যানে ৩-৪টি পোড়া মরদেহ পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় ২০টির বেশি মামলা করা হয়েছে।