সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাসিন্দাদের জীবন পুনর্গঠনে সহায়তা করার লক্ষ্যে মাস্তুল ফাউন্ডেশন একটি দীর্ঘমেয়াদী পূর্ণবাসন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মাসিক ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি ঘরবাড়ি পুনর্নিমাণে সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, শিশুদের জন্য শিক্ষা সহায়তা প্রদান, খামার ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সাবলম্বী হওয়ার সহায়তা প্রদান করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যার পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি জনসাধারণের। ধ্বংস হয়ে গেছে বাড়ি-ঘর ও রাস্তাঘাট। বাড়ি ফিরছে স্থানীয়রা কিন্তু নিজেদের বাড়িঘর কিছুই আর আগের মত নেই। ঘরবাড়ি আসবাবপত্র সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কারো কারো ভিটে-বাড়িটিও অবশিষ্ট নেই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়ী ও কৃষকরা। অনেকের ক্ষেত এখনও পানির নিচে, আবার অনেকের খামারে পানি ঢুকে মারা গেছে সব হাস-মুরগি, গরু-ছাগল। কারো ভেসে গেছে মাছ ঘের। বন্যা পীড়িত গ্রামগুলোতে পানি নেমে গেলেও জীবন হয়ে গেছে ছন্নছাড়া।
মাস্তুল ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক টিম তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, গ্রামের মানুষদের কথা শুনে অসহায় লাগে। গ্রামগুলোতে ত্রাণ দিতে গেলে বলে তারা বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি সব পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, এখন খাবার রাখার জায়গা কোথায় পাব?’ তাদের চোখে ক্ষুধার ছায়া।
প্রতিষ্ঠানটি পরশুরাম উপজেলায় একটি ভ্রাম্যমাণ মেহমানখানার আয়োজন করেছে যেখান থেকে প্রতিদিন ২৫০-এর অধিক পরিবারকে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়।
মাস্তুল মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা এক বানভাসী মিন্টু দাস জানান, বন্যায় তার ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বৃদ্ধ বয়সে চোখের সামনে এসব ক্ষতি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
মাস্তুল মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসে অপর ভুক্তভোগী সিকানদার আলী ও তার পরিবারের সবার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা আর হতাশার ছাপ। হতাশ এই পরিবারের সকল সদস্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। কথা বলে জানা যায়, বন্যায় তাদের বাড়িতে পানি উঠলে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায় কিন্তু খামারের হাঁস-মুরগিগুলো সঙ্গে নিতে পারেননি।
পানি কমলে বাড়ি ফিরে দেখেন খামারের কোনো চিহ্ন নেই। বসতবাড়িটি হয়ে গেছে বসবাসের অনুপযুক্ত। বাবার সাথে আসা ছোট্ট মেয়েটি কান্না করে বলে ওঠে, ‘বাসায় আমার একটাও বই-খাতা নেই, সব পানিতে নিয়া গেছে। এহন আমি কেমনে ইস্কুলে যাইতাম।’
মাস্তুল ফাউন্ডেশন অপারেশন হেড রায়হান রহমান বলেন, ‘আকস্মিক এই বন্যার শুরু থেকেই আমি ও আমার স্বেচ্ছাসেবক টিম ফেনী, পশুরাম, নোয়াখালি, কুমিল্লার জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও কাজ করছি। প্রায় সাড়ে তিন হাজার পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। একই সাথে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তবে আসল কার্যক্রম শুরু হবে এখন থেকে। পানি নেমে যাওয়ায় স্পষ্ট হয়ে আসছে ক্ষয়-ক্ষতিগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কারো কারো বাড়ি থাকলেও বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। টিউবওয়েল ও ল্যাট্রিন সবকিছু ভেসে গেছে বানের পানিতে। গ্রামের জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে এসবের পূর্ণনির্মাণ জরুরি।’
কর্পোরেট ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসেন আমরা একসাথে ওদের জীবনটাকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক করতে ভূমিকা রাখি।’
উল্লেখ্য, মাস্তুল ফাউন্ডেশন বন্যা কবলিত এক হাজার পরিবারকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। মাসিক ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজারটি ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, ৫০০ টিউবওয়েলের পূর্ণনির্মাণ, ২০০ ল্যাট্রিন এবং স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে ৫০০০ জনকে চিকিৎসা এবং ২৫০০ শিশুকে শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা হচ্ছে।
এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার কৃষক ও খামার ব্যাবসায়ীদের জন্য ফসলের বীজ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছের পোনা এবং অনান্য সহযোগিতার মাধ্যমে পুনরায় সাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মাস্তুল ফাউন্ডেশন বহুমুখী সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে নিজস্ব স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও বৃদ্ধআশ্রম যেখানে শতাধিক পিতামাতাহীন অনাথ/এতিম শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধ- বৃদ্ধা বসবাস করেন।
এর বাইরে কয়েকটি জেলায় প্রজেক্ট স্কুলগুলোতে হাজারের অধিক সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের সকল শিক্ষার উপকরণ দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাবার, শিশু অধিকার, মৌলিক চাহিদা নিশ্চয়তা করা হচ্ছে।
এছাড়া চিকিৎসা খাতে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মাস্তুল এইড’ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্ধশতাধিকের অধিক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অস্বচ্ছল পঙ্গুত্ববরণকারী রোগীদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি হুইলচেয়ার ও কৃত্রিম পা দিয়ে সাবলম্বী করছে।
মাস্তুল ফাউন্ডেশনের রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম করে তোলা হচ্ছে। এর বাইরে যাকাত স্বাবলম্বী প্রজেক্টের মাধ্যমে ১০০০ জনের বেশি মানুষকে স্বাবলম্বী করা হয়েছে।
মাস্তুলের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে দাফন-কাফন সেবা প্রজেক্ট, যার মাধ্যমে করোনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩০০০ এর অধিক লাশ দাফন হয়েছে। রয়েছে মাস্তুল মেহমানখানা, যেখান থেকে শতাধিক অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষের একবেলা পেট পুরে খাওয়ার ব্যাবস্থা হয়।