সারা বাংলা

রাতে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা, জনবল কম থাকায় ঠেকানো কঠিন 

মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের জেরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাতে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। সীমান্তে বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্তক অবস্থায় থাকার পরও অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। বিজিবি ও কোস্টগার্ডে জনবল কম থাকায় অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী। তিনি বলেন, দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা এদেশে অনুপ্রবেশ করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

এদিকে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্যরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে বলে জানা গেছে।

সীমান্তের বাসিন্দারা বলেন, সরকার পতনের পর কয়েকদিন সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে দালালরা। তারা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে। সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হলেও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দালালরা রাতের আঁধারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ভূমিকা রাখছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘর্ষের কারণে শত শত রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিছু রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চলেও এসেছেন। কতোজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তারা। তবে, তারা ধারণা করছেন, কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন।

উখিয়া কুতুপালং ১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে যেখানে (মংডুতে) হামলা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গার বসবাস। তারা নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন।’

গত ৫ আগস্টের পরে নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গত রোববার (৮ আগস্ট) পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রাতের অন্ধকারে টেকনাফের নাফ নদী সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন। এসব রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয়দের বাসা বাড়িতে অবস্থান নিতে না পারেন সেজন্য এলাকাবাসীকে সর্তক করা হয়েছে।

সীমান্ত সুরক্ষায় আরও কঠোর নজরধারীর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে কঠোরভাবে নজরধারী না রাখলে আবারও ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামতে পারে।

বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, সীমান্তে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। গত এক মাসে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে এমন ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিজিবির অভিযানে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকপাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪৩ জন চোরাকারবারি এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক ও ২২ জন ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

টেকনাফ নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, নৌ-পুলিশের ফাঁড়িতে বর্তমান কোনো কর্মকর্তা নেই। মাত্র চার জন সদস্য স্টেশনে রয়েছেন। তাদের কাছে কোনো জলযানও নেই। কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেলেও তাদের বাঁশি বাজানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। 

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্তের যে পরিস্থিতি তাতে বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে জনবল তা দিয়ে শতভাগ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্পে থাকা স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউ কেউ ভাড়া বাসায় অবস্থান নিচ্ছেন এমন তথ্যও মিলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তা সঠিক। বিজিবি ও কোস্টগার্ডে বিপুল সংখ্যক জনবল না থাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ৯ হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। যে সমস্ত দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তাদের ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হচ্ছে।’ 

সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য বলছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কম হলেও ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে। টেকনাফের বেশির ভাগ এলাকা জাদিমুড়া, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় অনু্প্রেবেশের চেষ্টা করছে। 

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয় স্বজনের কাছে রয়েছেন। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছেন তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’