গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল ছিল দিনাজপুর। সেদিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে চিকিৎসক দেখাতে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান আব্দুর রশিদ। হাসপাতালে টিকিট কাটতে গেলে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন তিনি। স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। তবে, দারিদ্রতার কাছে হার মেনে স্বামীর চিকিৎসার অর্থ যোগাতে তিন দিন বয়সী নবজাতক ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন দেন রোকেয়া বেগম।
এদিকে, গতকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে শিশুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিশুটির বাবা আব্দুর রশিদের চিকিৎসায় ৬৫ হাজার টাকা পরিবারটিকে দেওয়া হয়েছে বলে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) জানিয়েছেন দিনাজপুর সদর উপজেলার ইউএনও।
আহত আব্দুর রশিদ দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। তিনি দিনমজুরের কাজ করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট (রোববার) দুপুরে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের টিকেট কাউন্টারের সামনে পুলিশের ছোররা গুলিতে আহত হন আব্দুর রশিদ। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরের দিন ৯ আগস্ট (শুক্রবার) হাসপাতালে অপারেশন হয় তার। একই দিন শহরের রাজবাড়ী এলাকার বাসায় কন্যা সন্তানের জন্ম দেন স্ত্রী রোকেয়া বেগম।
হাসপাতালে স্বামীর চিকিৎসা চালানোর জন্য ১২ আগস্ট সোমবার রংপুরের এক দম্পতির কাছে ২৫ হাজার টাকায় কন্যা শিশুকে বিক্রি করতে বাধ্য হন রোকেয়া বেগম। সেই টাকা দিয়ে কোনো রকম স্বামীর চিকিৎসা চালানো হলেও এক মাস পর আরেকটি অপারেশন করতে বলেছেন চিকিৎসকরা।
আব্দুর রশিদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, ‘৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে আমার স্বামীর শরীরে গুলি লাগে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আমার স্বামীর অপারেশন হয়। অপারেশনের পর আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এর মধ্যে আমার সন্তান জন্ম নেই। সে সময় হাতে টাকা ছিল না। স্বামীর চিকিৎসা করাতে হবে তাই তিন দিনের সন্তানকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্তান বিক্রির টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করছি। সন্তান বিক্রি করায় খারাপতো লাগবে। সেই সময় কোনো উপায় ছিল না। স্বামীকে তো বাঁচাতে হবে। স্বামীকে আরও অপারেশন করাতে হবে। সুস্থ্য হতে সময় লাগবে। নিজেদের জায়গা-জমি নেই। মানুষের যায়গায় থাকি। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার স্বামী যেন সুস্থ্য হয়ে কিছু করতে পারে সেই ব্যবস্থা যেন তারা করেন।’
আহত আব্দুর রশিদ বলেন, ‘স্ত্রীর প্রসবের ব্যাথা উঠায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি টিকেট কাউন্টারের সামনে গেলে পুলিশ গুলি করে। সেসময় আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমি চিকিৎসা নিয়ে বাসায় আসি। এর মধ্যে আমার স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। বাসায় তিনদিন ছিলাম। পরে গ্রামবাসী সহযোগিতা করে আমাকে আবারও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। হাসপাতালে অপারেশন করা হয়েছে। আমি দিন আনি দিন খাই। অপারেশনে অনেক টাকার প্রয়োজন হওয়ায় আমার স্ত্রী একজনের কাছে সন্তানকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে।’
দিনাজপুর শহর জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুর রহিম বলেন, ‘আহত দিনমজুর আব্দুর রশিদকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। আমরা সব সময় পরিবারটির পাশে আছি।’
দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল রায়হান বলেন, গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে শিশুটিকে উদ্ধার করে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুটির বাবার চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে ৬৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।’
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনিক সহযোগিতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা বিক্রি করা শিশুটিকে গতকাল সোমবার উদ্ধার করে বাবা-মার কোলে তুলে দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক, সদর ইউএনও এবং এসিল্যান্ড বিষয়টি তদারকি করছেন। পরিবারটিকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন তারা।’