সারা বাংলা

বন্যায় লক্ষ্মীপুরে খামারিদের ক্ষতি পৌনে ৩ কোটি টাকা

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের চাঁদখালী গ্রামের বাসিন্দা মো. মাকছুদুর রহমান। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে ২০১৮ সালে নিজের সব সম্পদ বিনিয়োগে গড়ে তুলেছিলেন পোল্ট্রি মুরগির খামার। ১২০০ মুরগি দিয়ে শুরু করলেও সবশেষ সাড়ে তিন হাজার মুরগি ছিল তার খামারে। খামারের মুরগির বিষ্ঠা থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাসের মাধ্যমে প্রায় ১০টি চুলা ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় বেকার যুবকদের। স্বপ্ন ছিল খামারটি আরও বড় করবেন যেন এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

তবে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মাকছুদের সেই স্বপ্ন ভেসে গেছে। তিন লাখ টাকার লোকসানে পড়েছেন তিনি। বন্যায় মারা গেছে কয়েকশ’ মুরগি। আবার ঘুরে দাঁড়াতে অল্পসুদে ঋণের পাশাপাশি সরকারি সহায়তা চেয়েছেন এ উদ্যোক্তা।

পাশেই আরেকটি খামার গড়ে তুলেছেন তার বড় ভাই আব্দুল কাদের। বন্যার তারও ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। একই চিত্র জেলার অন্যান্য খামারিদেরও। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০টি মুরগি ও ৯৭৫টি হাঁস মারা গেছে। এতে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে পোল্ট্রি খামারি ও গৃহস্থদের।

জহির পোল্ট্রি ফার্ম-এর উদ্যোক্তা মাকছুদুর রহমান বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যায় সড়ক সংলগ্ন খামারে তিন ফুট ওপরে পানি উঠে যায়। খামারে থাকা লেয়ার মুরগি ও ডিম দেওয়ার উপযোগী হওয়া মুরগি মরে গেছে। যেগুলো জীবিত আছে, বৈদ্যুতিক লোডশেডিং সেগুলোও মারা যাচ্ছে। কোনোভাবেই এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না। এখন যদি সরকার আমাদের মতো খামারিদের স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেয়, তাহলে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’

একই কথাগুলো বললেন লাহারকান্দি গ্রামের পোল্ট্রি খামারি সাইফুদ্দিন, সিপন, রাসেল খাঁন এবং বেলাল মোল্লা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্যার অতিরিক্ত পানির কারণে লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে খামার ও গৃহস্থদের ১ লাখ ৬০ হাজার ২১৩টি পশুপাখি মারা গেছে। এর মধ্যে ৩৫টি গরু, ১৭৫টি ছাগল, ১৭টি ভেড়া ও একটি মহিষ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০টি মুরগি ও ৯৭৫টি হাঁস মারা গেছে।

এতে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশুসহ ৩০৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকার এবং হাঁস-মুরগিসহ ৪২৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এছাড়া ১ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকার পশুপাখির খাদ্য বন্যায় বিনষ্ট হয়েছে।

এছাড়া ৯০০ গবাদিপশু ও ১২ হাজার ৯০০ হাঁস-মুরগিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৮৪১টি গবাদিপশু ও ৩০ হাজার ৩৬৫টি হাঁস-মুরগির।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে ইতোমধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগরে ১৩ হাজার ৭৯০ একর জমি প্লাবিত হয়েছে। মেঘনা উপকূলীয় এ জেলায় প্রথমে ভারী বর্ষণ ও নদীর জোয়ারের কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। প্রথমে রামগতি ও কমলনগরের বিস্তর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। গেলো ২৩ আগস্ট থেকে ফেনী-নোয়াখালীর বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরে চাপ দেয়। এতে লক্ষ্মীপুরের জলমগ্ন হয়ে পড়েন প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। চারদিকে পানি থই-থই। অনেক এলাকায় কোমর-গলা সমান পানি ছিল। ঘর-বাড়ির ভিতরেও পানি। এতে পানি ও আবহাওয়া জনিত কারণে ১ লাখ ৬০ হাজার ২১৩টি পশু-পাখি মারা যায়।

রায়পুরের উত্তর চরমোহনা গ্রামের খামারি মো. ইউনুস বলেন, ‘এত পানি আমরা জীবনেও দেখিনি। ধারদেনা করে গরু লালনপালন করেছি। বন্যার পানিতে আমার তিনটি বড় গরু মারা গেছে। এখন আমার কী হবে?’

বশিকপুর ইউনিয়নের পোল্ট্রি খামারের মালিক মামুনুর রশিদ জানান, তার খামারে ৪ হাজার মুরগি ছিল। বন্যার পানিতে সব মারা যায়। এতে তার ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। একই অবস্থা বিরাজ করছে জেলার রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায়।

সদরের পূর্ব দিঘলী গ্রামের বৃদ্ধ হাফিজ উল্যা বলেন, ‘আমার ১৭টি গরু আছে। আমার বাড়ি বুক পানিতে ডুবে ছিল। এখনও কোমরের ওপর পানি। এজন্য রাস্তার পাশে বালু ফেলে ও উপরে ত্রিপল দিয়ে গরুগুলো রাখা হয়েছে। প্রতিদিন কলার ভেলায় করে বাড়ি থেকে গরুর জন্য খড় নিয়ে আসতে হয়।’

পশ্চিম জামিরতলি গ্রামের শাহ আলম জানান, তার দুটি গরু আছে। বাড়িতে এত পানি সেখানে নিজেদের থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। গরুর ঘরেও হাঁটু পরিমাণ পানি। এতে রাস্তার পাশে একজনের নির্মাণাধীন ভবনের নিচতলায় নিয়ে গরুগুলো রাখা হয়েছে।

মান্দারী গ্রামের দোকানি আইয়ুব আলী বলেন, ‘বাড়িতে যেতে বুক পরিমাণ পানি অতিক্রম করতে হয়। ঘরে খাট ছুঁই ছুঁই পানি। চারটি গরু নিয়ে খুব বিপর্যয়ে পড়তে হয়েছে। দিঘলী-মান্দারী সড়কটিও হাঁটুপানির উপরে ডুবে আছে। এতে বাড়ি থেকে গরুগুলো নিয়ে অন্যত্র রাখতে হয়েছে। গরুগুলো পাহারা দিতে গিয়ে রাতে ঘুমাতেও পারি না।’ লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুদ রঞ্জন মিত্র বলেন, ‘বন্যা-জলবদ্ধতার কারণে লক্ষ্মীপুরে ৩০৩টি গবাদিপশু ও ৪২৩টি মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক গবাদিপশু ও মুরগি মারা যাওয়ায় খামারিদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে মাঠ পর্যায়ে আমাদের লোকজন কাজ করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো ধরনের প্রণোদনা অথবা সহায়তা এলে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করব।’