সারা বাংলা

নিখোঁজ শাহাদতকে এক নজর দেখার আকাঙ্ক্ষা মা ও স্ত্রীর

টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব গোলচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শাহাদত হোসেন (২১)। বন্ধুদের সঙ্গে গত ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে ঢাকার সাভারে যোগ দেন তিনি। সেদিন বিকেলে মাকে ফোন করে শাহাদত জানিয়েছিলেন, সাভারে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, হয়ত ফিরতে পারবেন না। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। যে নম্বর থেকে শাহাদত ফোন করেছিলেন সেটিও তখন থেকেই বন্ধ। 

নিখোঁজ শাহাদত টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হালিম ও আসমা খাতুনের একমাত্র সন্তান। পেশায় এক্সকাভেটর (মাটিকাটা যন্ত্র) চালক ছিলেন। এক্সকাভেটর চালিয়ে যা উপার্জন করতেন তা দিয়েই স্ত্রী জিয়াসমিন ও পাঁচ মাস বয়সী সন্তান সানজিদাকে নিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শাহাদত নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশিরা তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মা আসমা খাতুন ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে হতাশ পরিবারটি। জীবিত বা মৃত যে অবস্থায় থাকুক শাহাদতকে এক নজর দেখার আকাঙ্ক্ষা স্ত্রী জিয়াসমিনের। এখন জিয়াসমিন একমাত্র সন্তানের ভরণপোষণ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি। গত রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) পরিবারটি শাহাদতের সন্ধান চেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

নিখোঁজ শাহাদত হোসেন

জানা গেছে, গত ৩ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব গোলচত্ত্রব এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শাহাদত। সেদিন রাতেই আন্দোলনে যোগ দিতে বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকার সাভারে যান তিনি। গত ৪ আগস্ট সকালে স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন শাহাদত। স্ত্রীকে ফোনে জানান, শিগগিরি বাড়ি ফিরবেন তিনি।

সেদিন বিকেলে শাহাদত তার মাকে অন্য একটি মোবাইল ফোন দিয়ে কল করেন। তিনি জানান, সাভারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেখানে গোলাগুলি চলছে। কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই। সেখান থেকে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে মাকে নিজের শঙ্কার কথা জানান শাহাদত। এরপর সেই ফোনে বারবার যোগাযোগ করলেও নম্বরটি বন্ধ রয়েছে।

ঘটনার পর শাহাদতের বাবা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গে ছেলের মরদেহ খুঁজেছেন। আত্মীয় স্বজনের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় সন্তানের খোঁজ করেছেন। কোথাও ছেলেন সন্ধান পাননি তিনি। 

স্থানীয়রা জানান, শাহাদত বিএনপির কর্মী ছিলেন। শাহাদত ও তার বাবার উপার্জনের টাকায় সংসার চলতো। ছেলেটি এলাকাতেও আন্দোলন করেছে। বন্ধুদের ডাকে ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হয়। তার একটি শিশু সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান সরকার যেন নিখোঁজ শাহাদতের সন্ধান দেয় এবং এই অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।

শাহাদতের স্ত্রী জিয়াসমিন বলেন, ‘কাজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর ঢাকায় গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। ফোনে আন্দোলনের কথা শোনার পরই ফিরে আসতে বললেও সে আসেনি। সে কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সেটাও জানতে পারলাম না। কতদিন ধরে তার খোঁজ পাচ্ছি না। জীবিত বা মৃত এই মানুষটিকে এক নজর দেখার ইচ্ছে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? মেয়েটা কথা শেখার পর কাকে বাবা বলে ডাকবে।’

শাহাদতের মা আসমা খাতুন বলেন, ‘নানার পরিবার বিএনপির সমর্থিত হওয়ায় বিএনপির লোকদের সঙ্গেই চলাচল করতো শাহাদত। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে এলাকাতে। গত ৩ আগস্ট কাজের কথা বলে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। পরদিন বিকেলে অন্য একটি নম্বর থেকে ফোন করে জানায়, সে আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে। চারদিকে গোলাগুলি হচ্ছে, অবস্থা ভয়াবহ। মনে হয় ফিরতে পারবো না। ফোনের ওপাশ থেকে অনেক গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপরই ফোন কেটে দেয় আমার ছেলে। এরপর আর তার খোঁজ পায়নি। আমার বাবাকে জীবিত বা মৃত এনে দেন। বাড়িতে এনে যেন এক নজর দেখার পর গোসল করিয়ে কবরটুকু দিতে পারি। এতে মনকে একটু হলেও সান্ত্বনা দিতে পারবো।’

শাহাদতের বাবা আব্দুল হালিম বলেন, ‘শাহাদতের সবশেষ কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গে ছেলের মরদেহ খুঁজেছি। কতো লাশ মর্গে পরেছিল অথচ ছেলের লাশ পাইনি। আমার ছেলের সন্ধান চাই। ডায়রি করতে থানায় কয়েক দিন গিয়েছিলাম। থানা পুলিশ ডায়রি নিতে রাজি হয়নি। গত রোববার ডায়রি নিয়েছে পুলিশ।’

এ বিষয়ে জানতে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম ভুইঁয়ার ফোন নম্বরে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।