সারা বাংলা

অতিবর্ষণে ও বেতনা নদীর বাঁধ ভেঙে ভাসছে সাতক্ষীরা

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে একের পর এক তলিয়েছে সাতক্ষীরা জেলার নিম্নাঞ্চলের গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে গেছে ছয় হাজার মৎস্য ঘের ও দেড় হাজার পুকুর। তলিয়ে রয়েছে আমনের ক্ষেত। 

অন্যদিকে বেতনা নদীর বাঁধ ভেঙে ও অতিবৃষ্টিতে অন্তত ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এখানেও বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচা ঘর। তলিয়ে গেছে কাঁচা-পাকা বসতবাড়ি, মাছের ঘের, আমন ধানের ক্ষেত শীতকালীন সবজি ও আবাদি জমির ফসল। পানিবন্দি হয়ে হতাশায় পড়েছেন এসব গ্রামের হাজারো কৃষক। এলাকার নারী, শিশু ও বয়স্করা পড়েছেন চরম বিপাকে। দুর্বিষহ জীবন-পার করছেন তারা। এদিকে, গত তিনদিনেও ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগের সব শেষ তথ্যনুযায়ী- অতিবৃষ্টিতে ভেসে গেছে ৬ হাজারের বেশি মৎস্য ঘের ও দেড় হাজারের বেশি পুকুর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলেও জানা গেছে। এদিকে জোয়ারে নদীতে বেড়েছে পানির উচ্চতা। এতে শ্যামনগর ও আশাশুনির এলাকায় আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলের মানুষ।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শ্মশানঘাটের পাশের বেতনা নদীর পাউবোর রিংবাঁধ রোববার সন্ধ্যায় ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। 

ভেঙে যাওয়া বাঁধ দিয়ে আহসাননগর, হরিণখোলা, গোয়ালপোতা, গাছা, দক্ষিণ নগরঘাটা, হাজরাতলা, পালপাড়া, গাবতলা, দোলুয়া, নগরঘাটা, রথখোলা, কাপাসডাঙ্গা, বেনেরপোতা, খেজুরডাঙ্গা, গোপীনাথপুর, তালতলা, নিমতলাসহ কমপক্ষে ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এ ছাড়া সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পুরোনো সাতক্ষীরা এলাকার ঘুটেরডাঙ্গী, রামচন্দ্রপুর, লবণগোলা, পাথরঘাটা, দামারপোতা, জিয়ালা, ধুলিহর, বালুইগাছ, ফিংড়ি, ফয়জুল্লাহপুর, দরবেশতিয়া, কোমরপুর, তেঁতুলডাঙ্গী, মাছখোলা, শ্যালেসহ ৩০টি গ্রাম ও পৌর এলাকার অর্ধেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওই এলাকাসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার মাছ ও কাঁকড়ার ঘের তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে পুকুর ও আমন ধানের খেত।

তালা উপজেলার হাজরাতলা গ্রামের কবীর হোসেন, দক্ষিণ নগরঘাটা গ্রামের মো. সাইফুল ইসলাম, রথখোলা গ্রামের আরিফ হোসেন ও আবদুর রহমান জানান, তাদের বাড়ির আঙিনায় হাঁটু সমান পানি। আশপাশের ৫০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি থেমে গেলেও বেতনা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা দিয়ে পানি ঢুকছে।

তালা উপজেলার শিরাশুনির আব্দুল আলীম জানান, তার মৎস্য ঘের ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এছাড়া শুভাসনি, শিরাশুনি, লাউতাড়াসহ একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো.অলিউর রহমান জানান, বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ মাঠসহ অনেক সড়ক তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মানুষ। এমন অবস্থা যে, চলাচল করতে গিয়ে মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। নর্দমার পানি এত নোংরা যে, পানি মাড়িয়ে রাস্তা পার হলে সঙ্গে সঙ্গে পায়ে চুলকানি শুরু হয়।

আশাশুনি উপজেলার দক্ষিণ দরগাহপুর গ্রামের মৎস্য চাষি বিপ্লব হোসেন ও আব্দুস সাত্তার মোড়ল জানান, তাদেরসহ এলাকায় ছোট বড় হাজারও মৎস্য ঘের তলিয়ে গেছে।  এলাকায় পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ নেই। পুকুর বসত বাড়ি ও রাস্তার ওপর পানি জমেছে। প্রতিবছরই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। অথচ দেখার কেউ নেই।

সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নুর খান জানান, টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের ইটেগাছ, মধুমল্যারডেঙ্গী, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, পলাশপোল, মেঠোপাড়া, কাটিয়া, মিলবাজার, থানাঘাটা, পুরোনো সাতক্ষীরা, রথখোলা, কুকরালি, দোহখোলা, চালতেতলা, বাটকেখালীসহ পৌর এলাকায় পানি উঠেছে। এসব এলাকার ৬০-৭০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তারা বাইরে বের হতে পারছেন না। 

তিনি বলেন, কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর ও তালা উপজেলার বড় অংশ পানিতে তলিয়ে রয়েছে।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, টানা বৃষ্টির পানিতে খাল-বিল সব ডুবে গেছে। ৫ হাজার হেক্টর ধানের ক্ষেত, তিন হাজার হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, এভাবে যদি পানির নিচে ধানগাছ তলিয়ে থাকে, তাহলে তা বাঁচানো যাবে না। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগের উপপরিচালক আনিসুর রহমান জানান, ৪ হাজার ৭৮২ হেক্টর আয়তনের ৫ হাজার ৭২১টি মাছের ঘের ও ৭৯৭ হেক্টর আয়তনের ১ হাজার ৮২৩টি পুকুর-দিঘি তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। 

তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে ঘের ও পুকুরের মাছ, স্লুইসগেটসহ সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের তোড়ে সাতক্ষীরা বেতনা নদীর বেনেরপোতা এলাকার রিং বাঁধের ২৫-৩০ মিটার ধসে পড়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে মেরামতের উদ্যোগ নিয়ে বস্তা ও বাঁশ পাঠানো হয়েছে। বড় গাছ (বল্লি) না থাকায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

তিনি আরও জানান, বুধবার কাজ শুরু করা হলেও নদীর স্রেতে বাঁধ আটকানো সম্ভব হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করা হবে।