পার্বত্য জেলা রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতায় একজন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। তবে, বান্দরবানে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। সম্প্রতি ওই দুই জেলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও পরিবেশ শান্ত রয়েছে বান্দরবানে। এই জেলায় পাহাড়ি ও বাঙালিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছেন।
একমাত্র বান্দরবানেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জাতিগোষ্ঠীর সবগুলোরই বসবাস রয়েছে। মারমা, চাকমা, ম্রো, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বোম, খেয়াং, চাক, পাংখো ও তঞ্চঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা এখানে বসবাস করেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত বান্দরবান জেলায় কোনো হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে এমন নজির নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা কিকিউ মার্মা বলেন, ‘সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তপাত হয়েছে। রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে এসব সৃষ্টি হচ্ছে। অচিরেই রাজনৈতিক মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার পাশাপাশি পাহাড়ে দীর্ঘদিনে যে সংঘাত সেটিও সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হলে এই সহিংসতা কমবে।’
বান্দরবান দুর্নীতি দমন কমিশনের সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী অংচমং মার্মা বলেন, ‘১৯৯৫ সালে ১৫ মার্চ পিসিপি (পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ) সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়েছিল। পিসিপি যে স্থানে সমাবেশ আয়োজন করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছিল, ঠিক একই জায়গায় বাঙালিরাও সমাবেশ আয়োজন করার অনুমতি চাইলে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। পিসিপি তাদের নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করতে চাইলে তখন সংঘর্ষ বাধে। পরে রাতে মধ্যম পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন প্রায় ৩০-৪০টি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হলে আর কোনো সহিংসতা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে কখনো সংঘর্ষ হবে না, এটা বলার সুযোগ নেই। দিনদিন যেভাবে লোকজন এগ্রেসিভ (উত্তেজিত) হয়ে উঠছে তাতে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।’
বান্দরবান সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কোনো দাঙ্গা বা সহিংসতা চাই না। ১৯৯৫ সালের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বান্দরবানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থান বিরজমান। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় কিছু ব্যক্তি চেষ্টা করছেন দাঙ্গা সৃষ্টির। বান্দরবানে একক কোনো সম্প্রদায়ের বসবাস নয়। এখানে বহুজাতি, বহু গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিতে বসবাস করছেন। কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়ানো উচিত হবে না।’
বান্দরবানে জেলায় ৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা। তিনি বলেন, ‘১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে বান্দরবানে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। এই জেলায় বাঙালি ও পাহাড়িরা সব সময় শান্তিতে বসবাস করছেন। আগামীতেও শান্তি বজায় যাতে থাকে সে কারণে সব পক্ষকে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
বান্দরবান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ওসমান গনি বলেন, ‘পাহাড়ি অথবা বাঙালি উভয়ই ঐক্য, মৈত্রী ও মিলেমিশে থাকায় বিশ্বাসী। আশা করি, কোনো প্রকার সহিংসতায় কোনো পক্ষ যাবে না। বান্দরবানবাসী শান্তিপ্রিয় মানুষ। বান্দরবানে শান্তি থাকবে। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও বান্দরবানে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে আশা করছি।’
বান্দরবান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হোসাইন মো. রায়হান কাজেমী বলেন, ‘বান্দরবানে এখনো কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। সারাবছর পাহাড়ি ও বাঙালিরা একসঙ্গে কাজ করছেন। বান্দরবানে কোনো সময় সহিংসতা হয়নি।’
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘হামলা এড়াতে একটি কোর কমিটি করা হয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ই পক্ষের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। সভায় পাহাড়ি ও বাঙালি দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা সম্প্রীতি বজার রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা কোনো ধরনের সহিংসতায় যাবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’