সারা বাংলা

বালুখেকোদের অত্যাচারে রূপ হারাচ্ছে যাদুকাটা

রূপ ও সম্পদের নদী যাদুকাটা। ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে যাদুকাটা নদীটি দেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তের কোলঘেঁষে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যাদুকাটা নদীর দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটার। এরপর রক্তি নদী হয়ে জেলার প্রধান নদী সুরমায় এসে মিলিত হয়েছে।

যাদুকাটা নদীর এক পাড়ে সবুজ বৃক্ষরাজিয় বারেক টিলা ও অন্যদিকে খাসিয়া পাহাড়। বর্ষায় নদীর বুক দিয়ে প্রবাহিত তীব্র স্রোতধারা আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে ধুধু বালুচর এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ধারণ করে।

বৈচিত্র্যময় মনোহর রূপের কারণে পাহাড়ি নদী যাদুকাটাকে দেশের অন্যতম সৌন্দর্যের নদী বলা হয়। কিন্তু বালু খেকোদের অত্যাচারে হুমকিতে রূপ ও সম্পদের যাদুকাটার পরিবেশ, নদী পাড়ের বসতভিটা, ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট।

দীর্ঘদিন থেকেই যাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছেন স্থানীয়রা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেটা আরও বেড়েছে। আগে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করা হলেও এখন প্রকাশ্যে নদীর পাড় কেটে বিক্রি, ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদীর যত্রতত্র থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।

নদীর পাড় কেটে বিক্রি করায় নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো বিলীন হচ্ছে। এছাড়া যাদুকাটা থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করায় পর্যটন স্পট শিমুল বাগানসহ আশপাশের অন্তত ২০ গ্রামের বাসিন্দারা বসতভিটা হারানোর শঙ্কায় উদ্বিগ্ন রয়েছেন। সেই সঙ্গে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

বালু খেকোদের অত্যাচার সইতে না পেরে মাঝেমধ্যে নদীপাড়ের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তবে প্রতিবাদ করলে বালুখেকো চক্রের সদস্যরা মারধর এবং মামলার হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এলাকাবাসী বলেন, যাদুকাটা নদীর তীরে কয়েক একর খাস জমি নিজেদের দাবি করে একটি চক্র ইঞ্জিনচালিত সেইভ মেশিন, ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। কখনো আবার নদীর তীর কেটে বিক্রি করছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসন অভিযোগ চালালে সাময়িকভাবে বালু উত্তোলন ও নদীর পাড় কাটা বন্ধ থাকলেও কয়েকদিন পর আবার শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। বালু খেকোদের অত্যাচারে রূপ হারাচ্ছে যাদুকাটা। নষ্ট হচ্ছে হাওরের ইকো সিস্টেম।

তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের ঘাগটিয়া গ্রামের আব্দুল মান্নান বলেন, জোরপূর্বক নদীর পাড় কেটে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে আমাদের বাড়িঘর বিলীন হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করতে পারি না। কারণ কিছু বললে ভয় দেখায়। তাদের সঙ্গে তো আর আমরা শক্তিতে পারব না।

লামাচরন গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ শুকুর আলী বলেন, দিন-রাত সবসময় নদী থেকে বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। এর ফলে বাড়িঘর, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। আমরা নিরীহ মানুষ। কার কাছে গেলে বিচার পাব? নদীর পাড় কাটায় বাঁধা দিলে আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় যাদুকাটা নদীর প্রস্থ মাত্র ১৮০ থেকে ১৯০ ফুট ছিল। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পাড় কেটে বিক্রি করায় এখন নদীর গড় প্রস্থ প্রায় কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।

লামারচর গ্রামের আরেক বাসিন্দা চুরাব মিয়া বলেন, এক সময় নদীতে বড় বড় চড় ছিল। এখন কোনো চড় নেই। যেই চড় ছিল তা কেটে খেয়ে ফেলেছে চক্র। শুধু চড় নয়, নদীর পাড় এমনকি গুচ্ছগ্রাম পর্যন্ত কেটে খেয়ে ফেলেছে। ফলে নদী এখন বিশাল বড় হয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর বুকে অবাধে চলছে ড্রেজার ও সেইভ মেশিন। এ সময় দাঁড়িয়ে থেকে কাজের তদারকি করছিলেন পাড় কাটা মহাজন ও ড্রেজার মালিকদের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে যাদুকাটা নদী থেকে বালু উত্তোলন ও পাড় কেটে বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও একই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত চন্দ্র সরকার। বর্তমানে উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশাহিদ মিয়া ওরফে রানু মেম্বারের নেতৃত্বে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও নদীর পাড় কেটে বিক্রি হচ্ছে।

শক্তিয়ারখলা গ্রামের অনিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে নদীর পাড় কাটা ও বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রানু মেম্বার। প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই, রানু মেম্বারসহ জড়িত সাবাইকে আইনের আওতায় আনার। নদীর প্রস্থ যে হাড়ে বাড়ছে ও গভীর হচ্ছে তাতে গ্রামগুলো ধ্বংসের মুখে যাচ্ছে।

তবে অভিযোগের বিষয় নাকচ করেছেন মোশাহিদ মিয়া ওরফে রানু মেম্বার। তিনি দাবি করে বলেন, আমার জন্য কুচক্রী মহল আরও নদীর পাড় কেটে বিক্রি ও বালু উত্তোলন করতে পারছে না। এজন্য তারা আমার নামে বদনাম ছাড়াচ্ছে। নদীর পাড় কাটতে বাঁধা ও বালু উত্তোলনে বাঁধা দেই বলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কিছুদিন আগেও একটি মামলা হয়েছে।

রানু মেম্বার উল্লেখ করে বলেন, সম্প্রতি কাশেম বাহিনী নদীর পাড় কাটতে আসছিল। তখন তাদের আমার লোক দিয়ে বাঁধা দেওয়ার পরেও মানে না। পুলিশের বাঁধাও মানে না। পরে তাদের পিটিয়েছি। এটাই আমার দোষ?

তিনি অভিযোগ করে বলেন, নদীর পাড় কেটে বিক্রি ও বালু উত্তোলনের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত নই। বরং স্থানীয় শাহরুল, কাশেম চেয়ারম্যান, রুহুল আমিন ও চাইম মিয়া মাস্টার এসবের সঙ্গে জড়িত। তারা তাদের পক্ষের লোকজন দিয়ে আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছে।

প্রতিনিয়ত নদীর পাড় কেটে বিক্রি ও নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর যেমন ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবেশ ও নদীর প্রবাহ বিলীন হওয়ার পথে। যাদুকাটা নদীর এই ধ্বংসযজ্ঞ গোটা হাওরাঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠছে বলে মরে করেন সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম সাঈদ।

তিনি বলেন, ১০ বছর আগেও যাদুকাটা নদীর যে গভীরতা ছিল। এখন তার থেকে আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। নদীর গভীরতা যদি এভাবে বাড়তে থাকে ও নদীর পাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়। তাহলে এই নদী আর নদী থাকবে না। নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার ফিল্ড অফিসার মো. সাফায়াত উল্লাহ বলেন, যেকোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ, খনিজ সম্পদ যদিও কারো বাড়িতেও উৎপত্তি হয়, তখন সেটার মালিক কোনো ব্যক্তি নয়। এটার মালিক সরাসরি রাষ্ট্র হয়ে যায়। ফলে সেখান থেকে আপনি কখনো সম্পদ আহরণ করতে পারবেন না। এটা আইনেও নেই। যারা নিজেদের জমি দাবি করে যাদুকাটার পাড় কাটছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে।

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, নদীর পাড় কেটে বিক্রি ও নদী থেকে বালু উত্তোলন রোধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে বালু উত্তোলন আগের থেকে অনেকটা কমে গেছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। 

এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।