সারা বাংলা

পৌরসভার টয়লেটে জন্মেছে গাছ, সাপ-খোপের আখড়া

গাইবান্ধা পৌরসভার ৯৫ শতাংশ কমিউনিটি টয়লেট এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলো এখন আর কোনো কাজে আসছে না। পৌর কর্তৃপক্ষও টয়লেটগুলো মেরামতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে জমে থাকা মলমূত্রের প্রচণ্ড দুর্গন্ধে টয়লেটগুলোর আশপাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করা মানুষরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। পরিবেশেও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব।

স্থানীয়রা জানান, পরিত্যাক্ত টয়লেটগুলোতে এখন সাপসহ বিভিন্ন ধরনের কিট পতঙ্গ বাস করছে। যে কয়টি টয়লেট ভালো আছে তাও ব্যবহার অনুপোযোগী।   

গাইবান্ধা পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের অর্থায়নে দ্বিতীয় নগর পরিচালন অবকাঠামো উন্নতিকরণ সেক্টর প্রকল্পের (ইউজিআইআইপি-টু) আওতায় গাইবান্ধা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ১০টি ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৪০টি কমিউনিটি টয়লেট এবং ৬২টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়। এতে ব্যয়  হয় ২ কোটি ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৫ টাকা। প্রতিটি টোয়াইন পিট (একসাথে দুটি) টয়লেটের সঙ্গে ড্রেন, সিসি রোড, ড্রেন স্লাব, ই-ফিলিংস, পলিসেড এবং টিউবওয়েল ধরা হয়েছিল। পৌরসভার দায়িত্বে এসব কাজ বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। 

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং  বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানো। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই বা সামর্থ্য নেই এমন কয়েকটি পরিবার মিলে একটি টয়লেট ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। 

গাইবান্ধার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সংস্কারের অভাবে পড়ে আছে দুটি কমিউনিটি টয়লেট

পৌরসভার দরিদ্র এবং ঘনবসতিপূর্ণ ১০টি নির্বাচিত এলাকার মধ্যে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কুটিপাড়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সবুজ পাড়া, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজপাড়া ও মাঝিপাড়া, ১ নম্বর ওয়ার্ডের রেল কলোনি, মাস্টার পাড়া, বিহারি পট্রি, হকার্স মার্কেট, কনকরায় এবং গুচ্ছগ্রামে টয়লেটগুলো তৈরি হয়। দরিদ্র পরিবার, পথচারী, পরিবহন যাত্রী, শ্রমিক এবং শহরে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা ভেবেই মূলত এসব কমিউনিটি টয়লেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কমিউনিটি টয়লেটগুলোর শতকরা ৯৫ ভাগই এখন ব্যবহার অনুপযোগী। পরিত্যক্ত হয়ে থাকায় এসব টয়লেটে তালা ঝুলছে। চারদিকে নোংরা পড়ে আছে। ড্রেনগুলো অচল হওয়ায় সেগুলোতে ময়লা পানি জমে আছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ এবং টয়লেটগুলোর চারপাশে মশা-মাছি ভনভন করতে দেখা যায়। ব্যবহার অনুপযোগী কিছু টয়লেটের সামনে রীতিমতো বড় বড় কলা গাছসহ বিভিন্ন আগাছা জন্মেছে। দুই-একটি টয়লেট ব্যবহার করা গেলেও সেগুলোর কোনটির দরজা ভাঙা, আবার কোনটির প্যান ভাঙা। হাত ধোয়ার জন্য সাবান নেই। নেই আলো কিংবা পানির ব্যবস্থা। অনেক টয়লেটের সংযোগ রিং ভেঙে সেখানে থেকে ময়লা পানি বের হতে দেখা গেছে। 

স্লাববিহীন ড্রেনের পাশে ময়লা আবর্জনার স্তূপ

কমিউনিটি টয়লেটের এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রথমত সঠিক জায়গায় এগুলো (টয়লেট) স্থাপন করা হয়নি। পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। চাহিদার নিরূপণে সঠিকতা যাচাই করা হয়নি। নরম মাটির ওপর স্থাপন করার কারণে অনেক টয়লেট নির্মাণের পরই দেবে গেছে। এছাড়া, একাধিক পরিবারের লোকজন ব্যবহার করায় জটিলতা তৈরি হয়। কতৃপক্ষের সঠিক তদারকি এবং যত্নের অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে টয়লেটগুলো। দ্রুত এগুলো মেরামত না করলে পরিবেশ আরও দূষিত হবে এবং ব্যবহারকারী পরিবার ও আশেপাশের মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।

কমিউনিটি টয়লেট ব্যবহারকারী ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পাপুল মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। এখানে বেশ কয়েকটি পরিবারের জন্য ল্যাট্রিন নির্মাণ করা হয়েছিল। সবগুলোই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সেগুলো থেকে সবসময় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। একটা ঠিক আছে, সেটা রয়েছে মানুষের বাড়ির ভেতর।’ 

সবুজ পাড়ার শাহানাজ বেগম বলেন, ‘টয়লেটগুলো যেদিন করে দিয়ে গেছে, তার কয়েকদিন পরেই মাটিতে দেবে গিয়ে ফেটে গেছে। এরপর ধীরে ধীরে এগুলো অচল হয়ে গেছে। কেউ খোঁজ পর্যন্ত নিতে আসেনি। টয়লেটগুলো নষ্ট থাকায় আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি।’

 রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টয়লেটের সামনে বিভিন্ন আগাছা আর কলাগাছ গজিয়েছে

একই পাড়ার অপর বাসিন্দা বুলবুলি বেগম বলেন, ‘টয়লেটের দুর্গন্ধের কারণে সারা দিন বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াই। রাত হলে খালি ঘরের মধ্যে ঘুমাবার যাই। এই গোন্দের (দুর্গন্ধের) কারণে ছোলপোল (ছেলে-মেয়ে) গুল্যার অসুখ ছাড়ে না। তোমরা কয়া (বলে) টয়লেট গুল্যা একনা ঠিক করার ব্যবস্থা করি দেও বাওয়া (বাবা)।’

গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘পৌর কর্তৃপক্ষের উচিৎ সঠিকভাবে খোঁজ খবর নিয়ে টয়লেটগুলো মেরামত করে ব্যবহার উপযোগেী করে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। একই ভাবে সার্বিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে শহরের পরিবেশ সুরক্ষা করা।’

গাইবান্ধা পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, জনসচেতনতা এবং জনসাধারণের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে স্থানীয় এনজিও এসকেএস। ‘রাইজিং ফর রাইটস’ নামে তারা একটি  প্রকল্প চলাচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সমন্বয়কারী জেভিয়ার স্কু রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গাইবান্ধা পৌরসভা এলাকার সাধারণ  মানুষের জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন সেবা  নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, নারী, শিশু এবং ট্রানজেন্ডারসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে এসডিজি’র যে লক্ষ্য, তা বাস্তবায়ন করা যাবে। অর্থাৎ সকলেই নিরাপদ স্যানিটেশন সেবার অন্তর্ভুক্ত হবে।’

তালা দেওয়া কমিউনিটি ক্লিনিক

গাইবান্ধা পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‌‌‘কঠিন বর্জ্যসহ স্যানিটেশনের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিবেশ দূষণের হাত থেকে গাইবান্ধা পৌরবাসীকে রক্ষা করতে কাজ চলমান রয়েছে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে টয়লেটগুলো্ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহা বলেন, ‘পরিত্যাক্ত টয়লেট থেকে সৃষ্ট ময়লা ও আবর্জনা থেকে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো সংস্কার করতে হবে।’

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহম্ম বলেন, ‘পৌর প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে দ্রুতই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’