সারা বাংলা

উঁচু জায়গা ও রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন শেরপুরের বন্যাদুর্গতরা

শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বন্যাদুর্গতরা উঁচু জায়গা ও রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন স্কুল ও কলেজকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা থাকলেও দুর্গত মানুষরা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। 

স্থানীয়রা জানান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে কোনো ধরনের মাইকিং, ঘোষণা বা প্রচারণা চালানো হয়নি। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত অনেক এলাকার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পানিতে তলিয়ে গেছে। যাদের থাকার জায়গা নেই, তাদের অনেকেই বাড়ি-ঘরের সম্পদ হারানোর ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যাচ্ছেন না। যাদের বাড়িতে থাকার মতো কোনো অবস্থা নেই, শুধু তারাই প্রধান সড়কে ও উঁচু জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন। কিছু কিছু এলাকার মানুষ পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকেই উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা অশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করাই আছে। দুর্যোগপূর্ণ সময় এই সমস্ত কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিয়ে থাকেন।

জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের তত্ত্বাবধানে দুর্গতদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

গবাদি পশু স্কুলে নিয়ে গেছেন অনেক পরিবার

জানা গেছে, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এবার ঝিনাইগাতী উপজেলার চারটি ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়নগুলোর বনকালি, বৈরাগী পাড়া, দিঘীরপাড়, চতল, বনগাঁও, হাতিবান্দা, দাড়িয়ারপার, কালিনগর, ফাখরাবাদ ও মানিককুড়াসহ বিভিন্ন গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামগুলোর অনেক পরিবারের সদস্য বাড়িতে আটকা পড়ে আছেন। নিজস্ব নৌকা না থাকায় তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। 

মহারশি নদীর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘রান্নাঘর, গোয়ালঘর, টিউবওয়েল ও টয়লেট সব পানির নিচে ডুবে গেছে। সকাল থেকে ঘরে চুলা জ্বলেনি। তাই পেটে এখনো দানা পরেনি। বিছানার ৩ ফুট উপর দিয়ে পানি যাচ্ছে। বাড়ির চারপাশে সবাই জাল দিয়ে মাছ ধরছে। কোথায় থাকবো? থাকার কোনো জায়গা নেই। রাস্তায় থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’

ফাকরাবাদ এলাকার বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বলেন, ‘বাড়ি ঘর ডুবে গেছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় চলে এসেছি। কার বাড়িতে উঠবো, কোথায় গিয়ে থাকবো বুঝতে পারছি না।’

বৈরাগীপাড়া এলাকার বাসিন্দা সেকান্দর আলী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখনো অনেক বাড়ির মানুষ পানিতে আটকা পড়ে আছে। তাদের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষ রয়েছে যারা হাঁটতে পারেন না। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। নৌকার অভাবে তাদের বাড়ি থেকে বের করে আনা যাচ্ছে না। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অনেক মানুষের প্রাণহানি  ঘটতে পারে।’

প্রেসিডেন্ট বাড়ি এলাকার আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ৭০ শতাংশ বাড়িঘর পানির নিচে। অর্ধেক মানুষের বাড়ি ঘরে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। অনেকেই বাধ্য হয়ে এক চৌকির ওপর আরেক চৌকি বসিয়ে উঁচু করে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেকেই রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। বড় ব্যাপার হচ্ছে, এখনো অনেক মানুষ আটকে পড়ে আছেন। তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যারা আটকা রয়েছেন তাদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া দরকার।’ 

ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘আমার নিজের বাসা পানিতে ডুবে গেছে। আমি সকাল থেকে নিজে সমস্ত উপজেলা পরিদর্শন করেছি। ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে উদ্ধার কাজ চলছে। স্কুল ও কলেজগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে আগে থেকেই ব্যবহার করা হয়। যাদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠতে পারেন। অনেক স্কুল কলেজেও পানির নিচে তলিয়ে গেছে।’

নালিতাবাড়ি উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএন) মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘সকাল থেকেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও  স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে আমরা সমস্ত উপজেলায় উদ্ধার অভিযান চালানোর চেষ্টা করছি। আমরা ইতোমধ্যেই আটকা পরা অনেক মানুষকে বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের অর্থায়নে এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অর্থায়নে খিচুড়ি রান্না করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নৌকার কারণে অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় তিন হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার আজ রাতের মধ্যেই আমাদের কাছে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।’

শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। এক রাতের বৃষ্টিতে হঠাৎ করে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলাগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া আছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র খোলার। উপজেলা প্রশাসনও আগে থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে রেখেছে। অনেক স্কুল-কলেজে পানির নিচে। ইতোমধ্যে আমরা পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার প্রস্তুত করেছি। সেগুলো উপজেলাগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্গত মানুষদের উদ্ধার করা।’