সারা বাংলা

কাঁদছেন শিক্ষক অহিদুল

অঝোরে কাঁদছেন অহিদুল। ৩২ বছর শিক্ষকতা করছেন একটি হাইস্কুলে। এমপিওভুক্তি তো দূরের কথা মেলেনি শিক্ষকতার স্বীকৃতি। অসাধু প্রধান শিক্ষকের অর্থলিপ্সার কাছে হেরে যাওয়ায় জোটেনি ন্যূনতম সম্মানি।

অভাবের সংসারে টানাপোড়েন, এরমধ্যেই ১২ কিলোমিটার দূরত্বের স্কুলে যাতায়াত করতেন অহিদুল। সন্তান আর স্ত্রীর আর্তনাদের মাঝেও বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেও হাল ছাড়েননি তিনি। বিদায়ের শেষ পর্যায়ে হলেও এমপিওভুক্তির স্বীকৃতি নিয়ে অহিদুল শেষ করতে চান তার কর্মজীবন।

সরেজমিনে চম্পাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণিতে ক্লাশ নিচ্ছেন শিক্ষক অহিদুল ইসলাম। এসময় বিনা বেতনে শিক্ষকতা আর শেষ সময়ে এসে চাওয়া পাওয়ার বিষয় নিয়ে কথা হলে, অহিদুল ইসলাম অঝোর নয়নে কেঁদে কেঁদে বলেন, এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাকালীন শিক্ষক আমি। অথচ বিগত দিনের প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিরা বারংবার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাকে বিনা পারিশ্রমিকে ৩২টি বছর খাটিয়েছে এই বিদ্যালয়ে।

অহিদুল বলেন, আমি ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারিতে জুনিয়র শিক্ষক পদে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করি। বিনা বেতনের সুদীর্ঘ এই শিক্ষকতা শেষে আগামী ২০২৫ সালের ১১ অক্টোবর বয়স পূর্তিতে অবসরে যাবো। আমার পরিবারের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে আশা করে আছে আমার শিক্ষকতার স্বীকৃতির খবরটি শোনার জন্য। পরিবারের সদস্যদের কথা দিয়েছি এক মাসের বেতন হলেও তাদের হাতে জমা দেবো। কিন্তু চাকরি শেষ পর্যায়ে এসেও এমপিওভুক্তির স্বীকৃতির চূড়ান্ত কোন সম্ভাবনা দেখছি না। 

এমনকি শেষ সময়ে চূড়ান্ত স্বীকৃতি না পেলে নিজেকে আত্মাহতির হুমকি দেন তিনি।

শিক্ষক অহিদুলের স্ত্রী রেহেনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী যৌবনকাল থেকে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রম দিয়ে আসছে বিনা পারিশ্রমিকে। এমপিওভুক্তি হতে খরচ বাবদ আমার স্বামী জমি বন্ধক রেখে কয়েক দফায় টাকা দিয়েছে তৎকালীন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডির সভাপতিকে। ৩২ বছর থেকে শুনে আসছি আগামী বছরে এমপিওভুক্তি হয়ে নিয়মিতভাবে বেতন পাবেন আমার স্বামী। কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়ন হয় না। এভাবেই কেটে গেছে ৩২টি বছর কিন্তু বেতন তো দূরের কথা শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তার। অথচ তারপরে শিক্ষকতা পেশায় ওই প্রতিষ্ঠানটিতে যুক্ত হয়ে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন অনেক শিক্ষক।

রেহেনা আক্তার বলেন, এসব ভেবে ভেবে আমার স্বামী এখন প্রায় পাগল হয়ে গেছে। আর এক বছর পরে তার চাকরি মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে এমপিওভুক্তি শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি না পেলে আত্মঘাতী হবে এমন কথা সে সব সময় আমাদের বলে। এনিয়ে আমরা একপ্রকার শঙ্কিত। 

তাই স্বামীর চাকরির চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি জানান স্ত্রী রেহেনা আক্তার।

চম্পাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের রফিকুল ইসলাম, সুভাষ চন্দ্র ও দুলাল চন্দ্র রায়সহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, রংপুরের তারাগঞ্জের অহেদুল স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে জুনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করেন। সেসময়ে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এক লক্ষ টাকা ডেনেশন দেন তিনি। ২০০৪ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। সেসময় তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অদৃশ্য কারণে অহিদুলের নাম বাদ দিয়ে তার স্থলে অন্য আরেকজনের কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেন। 

বিষয়টি নিয়ে অহিদুল প্রতিবাদ জানালে পরের বছরে তাকে ওই বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করানো হয়। সেসময়েও তার কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রেরণ করতে ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষককে অর্ধলক্ষ টাকা খরচ বাবদ দেন অহিদুল। কিন্তু সু-দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে অবসরের এক বছর আগেও অহিদুলের কপালে এমপিওভুক্তির সুখবর আসেনি। এই দীর্ঘ সময়ে চাকরির জীবনকালে অহিদুলকে স্কুলের পক্ষ থেকে একটি টাকাও ভাতা হিসেবে দেননি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ সহকর্মী শিক্ষকদের।

এরপর ২০২১ সালে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। আর ২০২২ সালে সরকারিভাবে বিলভাতার আদেশ পায়। সেখানেও বাদ যায় অহিদুলের নাম। অর্থ বাণিজ্যে যুক্ত হয় নতুন ব্যক্তি। নাটকীয় এসব ঘটনায় মর্মাহত অহিদুলের সহকর্মী শিক্ষকরাও।

প্রতিষ্ঠান প্রধানদের রোষানলে পড়ে চূড়ান্ত শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি না মিললেও পাঠদানে অহিদুলের সুনাম শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে। তারাও চান শিক্ষক অহিদুলের প্রকৃত অধিকার।

জানা যায়, অহিদুলের মতো আরো চার শিক্ষকের সাথে একইভাবে প্রতারণা করেছে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ। ১৫ বছর ধরে তারা বিনা বেতনে দায়িত্ব পালন করেছেন। বঞ্চিত এসব শিক্ষকদের অভিযোগের তীর বর্তমান প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি। 

বেতন বঞ্চিত সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর অদ্যাবধি এমপিওভুক্ত হননি তিনি। দফায় দফায় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললে অদৃশ্য কারণে বাদ পড়ে তাদেরও নাম। সবশেষ বর্তমান প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক তালবাহানা করে তাদের কাগজ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেনি। উল্টো তাদের কাছে অর্থ দাবি করেছে বলে অভিযোগ তার।

তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সরকার। তার দাবি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। আর এমপিওভুক্ত করতে অহিদুলের কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। 

এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রংপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন বলেন, দুই দফায় ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষককে অনলাইনে অহিদুলের কাগজপত্র প্রেরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খবর নিয়েছি তার কাগজপত্র অনলাইনে ইতিমধ্যে প্রেরণ করেছে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। আশা করছি খুব শিগগিরই এমপিওভুক্তির তালিকায় নাম যুক্ত হবে শিক্ষক অহিদুলের।