পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে বসেছে ভাসমান হাট। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাসমান হাটে নৌকায় নৌকায় চলে নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য কেনাবেচা। ভোর ৫টার মধ্যে হাট সরগরম হয়ে ওঠে আবার দুপুরের আগেই তা ভেঙে যায়। প্রায় ৭০ বছর আগে উপজেলার কলারদোনিয়া ইউনিয়নের বৈঠাকাটা বাজার ও বেলুয়া মুগারঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বেলুয়া নদীর বুকে বসে এ হাট।
জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কলারদোনিয়া ইউনিয়নের বৈঠাকাটা বাজার ও বলুয়া মুগারঝোর গ্রামের বেলুয়া নদী তিন মোহনায় বসে এ হাট। প্রায় ৭০ বছর ধরে স্থানীয় ২০ থেকে ২৫ গ্রামের কৃষকরা তাদের খেতের সবজি, ধান ও চাল কেনাবেচা করতে এ হাট চালু করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভোরে সূর্যোদয়ের পর বেলুয়া নদীর আশপাশ এলাকার খাল বেয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কৃষক সবজি নিয়ে হাটে যাচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ট্রলার ও বড় বড় নৌকা নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিচ্ছেন। হাটে বিভিন্ন প্রকারে তরকারী, নানা জাতের শাক সবজির খাদ্যশস্য ছাড়াও বেচাকেনা হয় ধান, চাল, মুড়ি ও নারকেলসহ শাক সবজি ও ফুলের চারা।
এছাড়াও হাটে আছে ভাসমান খাবারের দোকান। নৌকায় করে দোকানীরা চা, পান, সিগারেট, বিস্কুট, তেল পিঠা, চিতাই পিঠা ও বঢ়া পিঠা বিক্রি করে। এসব দোকানদাররা জানান, সপ্তাহের দুইদিন শনিবার ও মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার আগে এই ভাসমান হাট বসে সকাল ১১ মধ্যে আবার শেষ হয়ে যায়। প্রতি হাটে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা কেনাবেচা হয়।
উপজেলার মুগারঝোর গ্রামের কৃষক আবু সালেহ (৩৫) বলেন, আমাদের গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবার তাদের খেতে নানা জাতের শাক সবজির চাষ করেন। কৃষক তার উৎপাদিত সবজি বেলুয়া নদীর ভাসমান হাটে বিক্রি করেন। এ হাটে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় আশপাশের গ্রামগুলোর কৃষকরাও এখানে পণ্য বিক্রি করতে আসেন। এখান থেকে কৃষিপণ্য কিনে পাইকাররা রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলা, উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন।
সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈঠাকাটা বাজার থেকে আমি সবজি কিনে ট্রলারে করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করি। প্রতি হাটে সাত আট লাখ টাকার সবজি কেনাবেচা হয়। স্থানীয় আরও অনেক ব্যবসায়ী জানান, পঞ্চাশ দশকের শুরুতে মুগারঝোর গ্রামের সেকান্দার আলী সরদার, প্রয়াত কেরামত আলী, দলিল উদ্দিন সরদার ও আবুল কাশেম তালুকদার বৈঠাকাটা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।
জানা গেছে, ১৯৫৪ সালে বৈঠাকাটা বাজারের পাশে বেলুয়া নদীতে ভাসমান হাট বসা শুরু করে। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, মুগারঝোর, মনোহরপুর, গাঁওখালী, চাঁদকাঠি, ডুমুরিয়া, সাচিয়া, লড়া, বইবুনিয়া, পেনাখালী, নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া, গগণ, মলুহার, কাটাখালী, উলুহার, জনতা, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি, উমারেরপাড়, উদয়কাঠী, কদমবাড়ি, বাইশাড়ি, চৌমোহনা বাগেরহাটের শরনখোল সহ আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এ হাটে বিক্রি করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা হাট থেকে কৃষিপণ্য কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে যান।
বাজারের ইজারাদার মো. মহিউদ্দিন জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাজারের ইজারা নিয়ে আসছি। এই বাজারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা নিয়ে পাইকারী ক্রেতা বিক্রেতা আসে তাদের পণ্য কেনা বেচা করতে। এই বাজারে পণ্য রাজধানী ঢাকা শহরে চলে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের পর্যটক আসে দেখতে।
বৈঠাকাটা বাজার কমিটির সমন্বয়ক ও সাবেক ইউপি সদস্য মাহমুবুল আলম শানু জানান, এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম বাহন নৌকা। প্রতিটি কৃষক পরিবারে নৌকা ছিল। বাজার প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা নৌকায় করে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য হাটে নিয়ে আসতেন। ক্রেতারা কৃষিপণ্য কেনার জন্য নৌকায় করে হাটে আসতেন। বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে নৌকায় বসে চলত কেনাবেচা। এভাবে নৌকা থেকে নৌকায় পণ্য বেচাকেনা করতে করতে ভাসমান হাটের শুরু।
নাজিরপুর উপজেলার কলারদোনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসনাত ডালিম বলেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার। এ অঞ্চলের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষক। তাই স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়। এ হাটের কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। সারা বছর ধরে হাটে কেনাবেচা হলেও শীত মৌসুমে হাটটি জমজমাট থাকে বেশি।