‘তুফান’, শব্দটিতে মনে হবে তীব্র বাতাসকে বোঝানো হচ্ছে এমন। তবে, এই তুফান সেই তুফান নয়। তুফান হচ্ছে এক ক্যালিগ্রাফির নাম। যেটাকে গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল ক্যালিগ্রাফি বলা হয়। ইতোমধ্যে ক্যালিগ্রাফিটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত পেজ ও গ্রুপের আইডি থেকে পোস্ট করা হচ্ছে চিত্রটি। এতে বেশ প্রশংসায় ভাসছেন ক্যালিগ্রাফির চিত্রশিল্পীরা।
যারা এঁকেছেন ‘তুফান’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘তুফান’ নামক ক্যালিগ্রাফি এঁকেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফরিদপুর জেলার দুজন যুবক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলেটির নাম মো. ওমর ফারুক ও ফরিদপুরের উসাইদ মুহাম্মদ। দুজনই মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্র। মো. ওমর ফারুক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার দাওরায় হাদিস বিভাগে অধ্যয়নরত এবং উসাইদ মুহাম্মদ ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে তাকমিল ফিল হাদিস (মাস্টার্স) বিভাগ শেষ করে বর্তমানে এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত আছেন। উসাইদ মুহাম্মদ পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাস করেন। বাবা হারুন অর রশীদ অটো-মেকানিকের ওয়ার্কশপ চালান। মা হালিমা বেগম গৃহিণী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে উসাইদ মুহাম্মদ মেজো। এ ছাড়া, মো. ওমর ফারুক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরেই বসবাস করেন। ওমর ফারুকের বাবা মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন পুলিশ এবং মাতা ফিরোজা বেগম একজন গৃহিণী। ওমর ছাড়াও তার আরও তিন বোন রয়েছে।
যেভাবে শুরু
মো. ওমর ফারুক জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশে ছাড়েন, তখন থেকে নতুনভাবে দেশ স্বাধীনতা পায়। তখন থেকে সারা দেশেই দেয়ালে দেয়ালে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে প্রতিবাদের চিত্র তুলা ধরা হচ্ছিলো। তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে বেশ কয়েকটি ক্যালিগ্রাফি এঁকেছেন। তার চিত্রাঙ্কনের অন্যতম সঙ্গী হিসেবে ছিলো ফরিদপুরের উসাইদ মুহাম্মদ। গত ৫ আগস্টের পর পরই তাদের অঙ্কন করা একটি ক্যালিগ্রাফি বেশ সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করে। যার নাম ছিলো ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’। তারপর থেকে বৃহত্তর পরিসরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটে দেয়ালে অঙ্কন করে একটি আরবি শব্দের ক্যালিগ্রাফি। যেটি সেসময়ের জন্য ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল ক্যালিগ্রাফি। যেটি অঙ্কন করে সহযোগিতা করেছিলো ‘ক্লিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামক একটি সংগঠন। তারপর চলতি মাসের ১০ অক্টোবর তৈরি হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় ক্যালিগ্রাফি ‘তুফান’। আর এই ‘তুফান’ অঙ্কনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। অঙ্কনের ভাবনা ও কাজ যেভাবে শুরু
মো. ওমর ফারুক জানান, অঙ্কিত ক্যালিগ্রাফি আঁকা হয়েছে যুদ্ধ সময়ে বিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুরাতন পাওয়ার হাউজ ভবনে। যার নামেই এলাকাটি শিমরাইলকান্দি এলাকার ‘পাওয়ার হাউজ রোড’ হিসেবে বেশ পরিচিতি। যুদ্ধকালে ধ্বংস হওয়া এই ভবনটি দেখে ফিলিস্তিনের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির কথা মাথায় আসে। আর সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ধ্বংসাত্মক এই ভবনে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের কিছুটা তুলে ধরার বিষয়টি বন্ধুমহল ও এলাকার লোকজনদের সাথে আলাপ করার পর তাদের সহযোগিতায় ওমর ও উসাইদ গত ৫ অক্টোবর ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করে। তবে, শুরুতেই যেন বাধে বিপত্তি। বিশাল এই জরাজীর্ণ ভবনে ফিলিস্তিনের সেই বিধ্বস্ততা ফুটিয়ে তুলতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা কাজ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘তুফান’ অঙ্কনের শেষ দুদিন নির্ঘুম হয়ে কাজ করেছেন তারা। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে পরের দিন ভোর সকাল ৬টা অবধি কাজ করেছেন। এভাবেই নিরলস পরিশ্রমের পর দীর্ঘ ৭ দিনে কাজটি সমাপ্ত করতে পেরেছেন। ফারুকের ভাষ্য, কাজটি যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে ফিলিস্তিনের যে বিষয়গুলো রয়েছে যেমন- আল আকসা মসজিদ, ইসরায়েলি হামলায় বিভিন্ন দালান-কোঠা ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া, ধোয়া উড়ছে। সেই ভবনের নিচে একজন সৈন্য হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে ভবনের উপরে উঠছে।
চিত্রশিল্পী ওমর ও উসাইদের সহোদর সাঈদ সালমান জানান, চিত্রটি অঙ্কনের পূর্বে দীর্ঘ এক মাস বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা করেন। শুধু তাই নয়, পাওয়ার হাউজের এই ভবনটিতে আল আকসার পরিবেশ কীভাবে ফুটিয়ে তুলা যায়, বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। বিষয়টি এতো সহজ ছিলো না। এত বড় ভবনে এমন একটি অঙ্কনের খরচ ছিলো ব্যয়বহুল। অতঃপর এলাকার লোকজনদের সহযোগিতায় তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে এমন একটি ক্যালিগ্রাফি উপহার দিতে পেরেছেন। পাওয়ার হাউজ রোডের স্থানীয় বাসিন্দা ও অন্যতম সহযোগী মোহাম্মদ রকি জানান, ওমর ও উসাইদরা বিষয়টি পাওয়ার হাউজের জরাজীর্ণ ভবনটিতে এমন একটি চিত্র অঙ্কন করতে চায়, প্রস্তাব নিয়ে আসে। তখন একটি ভালো কাজে নিজেকে অংশ করতে অর্থনৈতিক ও মানসিকসহ যেভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন, চেষ্টা করি। আজ তারা এমন চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কাজের প্রাপ্তি প্রতিটি অঙ্কনের পেছনে একটি বার্তা থাকে, আর সেই বার্তাটি মানুষ বোঝতে পারাটাই প্রাপ্তি বলে মনে করছেন চিত্রশিল্পী ওমর ফারুক। তিনি বলেন, একটি অঙ্কনের যে বার্তা রয়েছে, সেটি পেয়ে সাধারণ মানুষ বা দর্শনার্থীরা উচ্ছ্বসিত হচ্ছে, দোয়া করছে সেটিই আমাদের প্রাপ্তি। ইতোমধ্যে ক্যালিগ্রাফি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। আর এতেই আমরা যে প্রশংসা কুড়িয়েছি, একজন চিত্রশিল্পীর এর চেয়ে বেশি কোনও প্রাপ্তির প্রয়োজন নেই।
অঙ্কনটি নিয়ে যা বলছেন দর্শনার্থীরা
সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রিমন মিয়া বলেন, আল আকসা মসজিদের ছবিটি একটি চমৎকার দৃশ্য। ইতোমধ্যে ছবিটি নিয়ে সকলেই অনেক প্রশংসা করছেন। আর যারা ছবিটি এঁকেছেন তারা ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ নামের একটি প্রশংসিত ক্যালিগ্রাফি এঁকেছেন। ভাঙা একটি ভবনে এত সুন্দর চিত্র হতে পারে, সেটি অনেকের জন্য শিক্ষণীয়। যারা এঁকেছেন আর যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে ধন্যবাদ।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, ছাত্র-জনতা নতুন একটি বিজয় এনেছে বলে মনে করি। আর সেই বিজয়ে নতুন সূর্যোদয় হবে, সেটা সকলেরই আশা। অঙ্কনটি খুবই প্রশংসনীয়।