সারা বাংলা

সম্প্রীতির মেলবন্ধন বনরূপার পাহাড়ি বাজার

পার্বত্য রাঙামাটিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস। চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরাসহ আরো বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর পাশাপাশি বসবাস রয়েছে বাঙালিদেরও। দেশের বৃহত্তম কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের তীরে গড়ে উঠা রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজারে প্রতিদিন দেখা যায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নরনারীর উপস্থিতি। শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপায় রয়েছে শহরের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি বাজার। আর এই পাহাড়ি বাজারে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিলনমেলায় ফুটে উঠে সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

এই বাজারে পাহাড়ে জুমে উৎপাদিত রাসায়নিকবিহীন সব ধরনের তরিতরকারি, ফলমূল ও সবজি পাওয়া যায়। কত ধরনের ফল-শাকসবজি পাহাড়ে উৎপাদন হয়, তা এই বাজারে না এলে কেউ বুঝতেই পারবে না। নিত্যকার জীবনে অনেক ফেলনা শাকসবজি কিংবা ফলমূলও এই বাজারের ক্রেতাদের রয়েছে চাহিদার তালিকায়। বাঁশও যে খেতে পারা যায়, তা এই বাজারে না আসলে কেউ বুঝতেই পারবে না। কারণ এখানে কচি বাঁশ সবজির উপকরণ হিসেবে বিক্রি হয়ে থাকে।

 

কাইন্দ্যা, বন্দুকভাঙ্গা, বালুখালী, বসন্তপাড়া, মাইসছড়ি, নতুনপাড়া, কিল্লামুড়া, নানিয়ারচর, বুড়িঘাটসহ আরও অনেক পাহাড়ি গ্রাম থেকে জুমের উৎপাদিত ফসল ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বাজারে নিয়ে আসেন পাহাড়িরা। সপ্তাহের সাত দিন এই বাজার বসলেও প্রতি শনি ও বুধবার এখানে হাট বসে। 

হাটবারে দেখা যায়, ভোর থেকেই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নিজেদের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল নিয়ে বনরূপা বাজারের শেষ মাথায় সমতা ঘাটে ভিড়তে শুরু করেন পাহাড়ি নারী-পুরুষেরা। শাকসবজির পাশাপাশি কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরণ করা মাছ ও নিজেদের খামারে উৎপাদিত শূকরের মাংস নিয়েও ভিড় করেন বিক্রেতারা। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ নানান প্রাণী। 

পাহাড়ি সবজির মধ্যে জুম থেকে সাবারাং পাতা, আমিলা গোটা, বাচ্চুরি (বাঁশ কোড়ল), মারফা, ধাইন্যা মরিচ (ছোট ঝাল মরিচ), কচুর ছড়া, কলার থোড়, আলু শাক, কলমি শাক, জুম কুমড়া, জুমের বেগুন, জুমকচু, কলার মোচা, তিত বেগুন, বিলাতি ধনেপাতা, মুলা শাক, লাউ শাক, পুঁই পাতা, পুঁই ডাটা, পুঁই বিচি, চিচিঙ্গা, কাঁচা ও পাকা পেঁপে, কাঁচকলা, জাম্বুরা, আনারস, কচি কাঁঠালসহ বিভিন্ন শাক-সবজি ও ফল-মূল নিয়ে বিক্রেতারা হাজির হয় এই বাজারে। এই হাটে বিক্রেতা হিসেবে নারীদের প্রাধান্যই বেশি।

 

এসব সবজির অনেকগুলোই বনে জন্ম নেওয়া আবার কিছু জুমের খেতে উৎপাদিত। এছাড়া ড্রাগন ফল, পাহাড়ি মাল্টা, জলপাই, তেঁতুল, পেঁপেসহ নানান পদের ফলমূলের সমারোহ চোখে পড়ে। পাহাড়ে বিপুল পরিমাণ কলা উৎপাদন হওয়াতে বাজারে আলাদা করে কলার বাজার বসে। বিভিন্ন কলার মধ্যে বাংলা কলাই বেশি পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে গরুর দুধ বোতলে এনে বিক্রি করা হয়। পাহাড়িদের গরুর দুধের বেশ সুনাম। তাই বিক্রিও হয় ভালো। বাঁশের দইও বিক্রি হয় এ বাজারে। 

হাটে কথা হয় জুমের সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য আসা সোনালী চাকমার সাথে। রাঙামাটির অদূরে কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপগ্রাম বালুখালী থেকে তিনি প্রতি শনি ও বুধবার এই হাটে আসেন। প্রতি সপ্তাহে জুমে যে ফসল উৎপাদন হয়, সেগুলো নিয়ে হাটে আসেন তিনি। এসব পণ্য বিক্রি করে যা পান, তা-ই দিয়ে সপ্তাহের বাকি দিনের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার ক্রয় করে ফেরেন গ্রামে। এভাবে চলে সোনালী চাকমার সংসার। শুধু সোনালী চাকমা নন। এভাবে শহরের অদূরে কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিয়ে প্রতি সপ্তাহে হাটে আসেন পাহাড়িরা। তবে বাজারে সাধারণত পাহাড়ি নারীদেরই পণ্য বিক্রি করতে বেশি দেখা যায়। পুরুষরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ না থাকলে হাটে না এসে গ্রামেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই নারীরাই বেশিরভাগ খেতে জুম থেকে পণ্য নিয়ে একটি বোটে গ্রামের ১৫-২০ জন মিলে হাটে আসেন। প্রতিটি গ্রাম থেকে হাটের দিন ২০-৩০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আসে। 

বিক্রেতা কিলা চাকমা বলেন, ‘আমি শামুক, মহিষের চামড়া ও ক্ষীরা নিয়ে এসেছি। শামুক ২০০ টাকা, মহিষের চামড়া ১৫০ টাকা এবং ক্ষীরা ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। শনি ও বুধবার বাজারে ভালো বিক্রি হয়।’

যে সময়ে যে মৌসুম থাকে; সে সময়ে তারা ওই ফসল সংগ্রহ করে বাজারে এনে বিক্রি করেন বলে জানান তিনি। 

জুমের রাসায়নিকহীন টাটকা ফল ও সবজি কিনতে প্রতি শনি ও বুধবার হাট-বাজারে ভিড় করেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি জেলার বাইরে থেকেও পাইকাররা বিভিন্ন ফল সংগ্রহ করতে হাটে আসেন। 

হাটে কিনতে আসা সুমনা চাকমা বলেন, ‘বাসার জন্য প্রতি শনি ও বুধবার জুমের টাটকা শাক-সবজি কিনে নিয়ে যাই। হাটের দিন এসব পণ্যের দাম একটু কম থাকে। পাশাপাশি টাটকাও পাওয়া যায়। তাই প্রতি শনি ও বুধবারে শাক-সবজি ও ফলমূল কিনতে হাটে আসি।’ 

আরেক ক্রেতা প্রশান্ত চাকমা বলেন, ‘এখানে সপ্তাহে দুইদিন শনি ও বুধবার বাজার হয়। তবে আমাদের পাহাড়িদের জন্য বুধবারের বাজারটাই মূল। দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়িরা এখানে বিভিন্ন সবজি, ফল, মাংস নিয়ে আসেন বিক্রি করতে। সেগুলোতে কোনো ভেজাল মেশানো হয় না বলে আমরা এখান থেকে কেনাকাটা করে খুব শান্তি পাই।’ 

বাজার করতে আসা ক্রেতা বোরহান উদ্দিন বলেন, এই বাজারের পণ্যগুলোর মূল বিশেষত্ব হলো ভেজালমুক্ত। এখানে বিক্রি হওয়া প্রায় প্রতিটি শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংসে কোনো ধরনের ভেজাল মিশানো হয় না। পাশাপাশি সবকিছুই তাজা পাওয়া যায়। হাটের দিনগুলোতে নানান পদের তাজা শাক-সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চাল, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন মশলাও পাওয়া যায়। এই বাজারটি পাহাড়ি-বাঙালিদের একটি মিলনমেলাও বটে।