সারা বাংলা

দুর্গম পাহাড়ে প্রসবকালে নারীদের বিপদের বন্ধু রাশেদা

প্রসবকালীন সময়টাকে মায়েদের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ বলা হয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত হলেও সহজে যানবাহন না মেলা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো প্রসব ঝুঁকি বেশি। এসব প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন কাজী রাশেদা বেগম। 

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি এলাকায় ধাত্রী হিসেবে আলাদা পরিচয় গড়ে তার। এখানে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।

২০০১ সালের পহেলা আগস্টে নিজের দ্বিতীয় সন্তান প্রসবকালে কষ্ট আর দুর্দশা থেকে নিজেকে একজন সেবিকা কিংবা ধাত্রী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এই নারী। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২, ৩ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের সদস্যও ছিলেন। 

দশ বছরে ৬ হাজারের বেশি শিশুর জন্মদানে ধাত্রী হিসেবে পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটে গিয়ে স্থানীয়দের সেবা দিয়েছেন ‘মেম্বার আপা’ হিসেবে পরিচিত এই অদম্য নারী। প্রসবকালীন বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা এবং পরামর্শ দিয়ে গর্ভবতী নারীদের বিপদের বন্ধু বলে খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। 

স্থানীয়রা জানান, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাটি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী। দুর্গম এই পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী গর্ভবতী নারীদের দুঃসময়ে রাতবিরাতে ছুটে যান কাজী রাশেদা বেগম। ২০ বছর ধরে গর্ভবতী নারীদের সন্তান জন্মদানে ধাত্রী হিসেবে সহায়তা করা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। ২০০২ সালে সূর্যের হাসি ক্লিনিক থেকে তার ধাত্রী বিদ্যার হাতেখড়ি। ধাত্রী পরিচিতি ২০১৯ সালে তাকে জনপ্রতিনিধি হতে সহায়তা করেছে। 

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মসজিদ ঘোনা, বিছামারা, চাকঢালা, আশারতলীসহ বিভিন্ন গ্রামের উপকারভোগী নারীদের সংখ্যা কম নয়। দিনে বা রাতে যখনই মুঠোফোনে তাকে খবর দেওয়া হয় ছুটে যান গর্ভবতী নারীদের সেবায়। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও থেমে যায়নি রাশেদার মাতৃসেবা। বরং জনসম্পৃক্ততার কারণে বেড়েছে তার সেবার পরিধি। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেখানে অসহায় দরিদ্র নারীরা হাসপাতালে যেতে অনিহা প্রকাশ করেন, সেখানে রাশেদা ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ইতোমধ্যে গর্ভবতী নারীদের সেবায় স্থানীয় মানুষের ভরসার জায়গা দখল করে নিয়েছেন তিনি। 

মসজিদ ঘোনায় গত ১৫ অক্টোবর ভুমিষ্ঠ সন্তানের মা হালিমা বেগম বলেন, আমার প্রতিটা সন্তান প্রসবের সময় রাশেদা বেগমকে পাশে পেয়েছি। আল্লাহর রহমতে স্বাভাবিকভাবে সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে রাতে যখন প্রসব বেদনা শুরু হয় তখন রাস্তায় গাড়ি ছিল না। হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওই মুহূর্তে রাশেদা বেগমকে খবর দিলে তিনি তাৎক্ষণাৎ এসে সেবা দেন। সারারাত সেবাদানের পর সকালে সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখার পর তিনি বাড়ি গেছেন। এই সেবার কথা জীবনেও ভুলার মতো নয়। 

জামছড়ি এলাকার ইয়াসমিন আক্তার বলেন, পুরো এলাকায় কোনো গর্ভবতী নারী প্রসব বেদনায় ভুগলে রাশেদা আপাকে খবর দেয়। তিনি এসে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। সম্ভব হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। গভীর রাতে কিংবা এলাকায় যাদের অবস্থা হাসপাতালে নেওয়ার মতো না, তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে সেবাযত্ন দিয়ে সন্তান প্রসবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন তিনি। 

কাজী রাশেদা বেগম বলেন, আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় বড় ধাক্কা খাই। একদিকে পারিবারিক কলহ অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট সবমিলিয়ে অনেক হিমশিম অবস্থার মধ্যে ছিলাম। ২০০১ সালের পহেলা আগস্ট প্রসব বেদনা শুরু হলে এলাকাবাসী হাসপাতালে নিয়ে গেলে পেটে বাচ্চা মারা গেছে বলে জানায়। মনকে বুঝাতে না পেরে অপারেশন না করে বাড়ি চলে আসি। পরদিন আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে আমার কুলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে সন্তান।  

তিনি আরও বলেন, তখন থেকে প্রতিজ্ঞা করি নিজেকে একজন সেবিকা হিসেবে গড়ে তুলবো। আর কোনো নারী যেন আমার মতো প্রসব বেদনায় কষ্ট না পায় সেজন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে ধাত্রী হিসেবে কাজ করে যাবো। সেই লক্ষ্যে এ পর্যন্ত গর্ভবতী নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমার হাতে ৬ হাজারের বেশি স্বাভাবিকভাবে শিশুর জন্ম হয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি আল্লাহর রহমতে। আমি ভালো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। গর্ভবতীর অবস্থা জটিল হলে সাধ্যমতো নিজ খরচে স্বাস্থ্য বিভাগে পাঠাই।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নবজাতক ও শিশুরোগ চিকিৎসক ডা. এজেডএম সেলিম বলেন, প্রথমে কাজী রাশেদা বেগমের কর্মকাণ্ডগুলো স্বাস্থ্য উপযোগী কিনা তা নিয়ে আমাদের মধ্যে ধোঁয়াশা ছিল। তাকে আমরা যাচাই করেছি। কিন্তু খবর নিয়ে দেখলাম তার সেবায় গত ২০ বছরে একজন শিশুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিষয়টি জানার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাকে গ্লাভস্, স্যানিটাইজারসহ জরুরি প্রয়োজনীয় মেডিসিন ইত্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। 

এই চিকিৎসা কর্মকর্তা আরও বলেন, কাজী রাশেদা বেগমের কাজটি অত্যন্ত ভালো কাজ বলে মনে হয়েছে। তিনি জনপ্রতিনিধি থাকাবস্থায় শত ব্যস্ততার মাঝেও গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের আন্তরিক সেবা দিয়ে গেছেন। এখনো কোনো নারীর প্রসব বেদনায় কাতরানোর খবর পেলে সময়ের দিকে না তাকিয়ে ছুটে যান সেবা দিতে। আমাদের পক্ষ থেকে রাশেদার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা থাকবে।