সারা বাংলা

খেতুরীধাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ

যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে বৈষ্ণব ধর্মের মহাপুরুষ নরোত্তম দাস ঠাকুরের তিরোভাব তিথি মহোৎসব। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুরীধামে প্রতিবছর সারা দেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ নরোত্তম ভক্ত এ উৎসবে যোগ দেন। অনেকেই অবস্থান করেন আশপাশের মুসলমানদের বাড়ির উঠানে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেন। কোনো দিনই এ উৎসব ঘিরে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি।

নরোত্তম ঠাকুরের তিরোভাব তিথি উপলক্ষে এবার ৪৯০তম মহোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর লক্ষ্মী পূর্ণিমার পাঁচদিন পর পঞ্চমী তিথিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সারা দুনিয়ায় বৈষব ধর্মের অনুসারীদের পাঁচটি ধাম রয়েছে। এরমধ্যে চারটিই ভারতবর্ষে। বাংলাদেশের একমাত্র ধাম এই খেতুরে। তাই বাংলাদেশের সনাতন বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক। দেশের আর কোথাও বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের এত বড় জমায়েত হয় না।

আগামীকাল সোমবার (২১ অক্টোবর) থেকে শুরু হচ্ছে এ বছরের তিন দিনের এই মহোৎসব। সোমবার সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হবে। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) অরুনোদয় থেকে অষ্টপ্রহরব্যাপী চলবে নাম সংকীর্ত্তন। বুধবার (২৩ অক্টোবর) ভোগ মহোৎসব, দধিমঙ্গল ও মহান্ত বিদায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হবে অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ইতোমধ্যে নরোত্তম ভক্তরা ধামে আসতে শুরু করেছেন। সেইসঙ্গে আয়োজকদের পক্ষ থেকেও চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।

শনিবার বিকালে খেতুরীধামে পৌঁছানোর সময় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখা গেল দুই কিলোমিটার দূরের বসন্তপুর এলাকায়। রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে সেখানে। বসন্তপুর-প্রেমতলী সড়ক ধরে খেতুরীধামের দিকে যেতে চোখে পড়ল ভক্তদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে বিশালাকার সব প্যান্ডেল। মহোৎসব ঘিরে প্রতিবছর বসে গ্রামীণমেলাও। থাকে খাবার ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের দোকান। খেতুরীধামের আশপাশে মুসলমানদের জমির ওপরে বসে এ মেলা। তৈরি করা হয় ভক্তদের থাকার প্যান্ডেল। বিকালে এসবই তৈরি করতে দেখা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা সমাজসেবক এহসানুল কবির টুকু জানান, উৎসব চলাকালে প্রেমতলী থেকে বসন্তপুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধু ভক্তদের ভিড় থাকে। ওই তিন দিন মাইকে ২৪ ঘণ্টা কীর্ত্তন চলে। আশপাশে সব মুসলমানদের বাড়ি, কিন্তু কখনও কোনো সমস্যা হয় না। বরং মুসলমানরাও এ অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। বাড়ির উঠানে ভক্তদের থাকতে দেন। নির্দ্বিধায় বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করতে দেন। খেতুরীধামের আশপাশে মেলা বসবে বলে মানুষ একটু আগাম ধান চাষ শুরু করে। ধান কেটে নিয়ে জমি ফাঁকা রাখে।

খেতুরীধামের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ দিকে অফিস। উত্তরে সারি সারি ছয়টি মন্দির। মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা দিচ্ছেন ভক্তরা। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার প্রতাপ গ্রাম থেকে মা ও বৌদিকে নিয়ে এসেছেন খোকন চন্দ্র শীল। তিনি বলেন, ‘আমরা একটু আগে আগে চলে এসেছি। কয়েকশত বাস নিয়ে ভক্তরা সোমবারের মধ্যে চলে আসবেন। এই বাসগুলো থাকবে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে কিংবা সাধারণ মানুষের জমিতে। কেউ কখনও বাধা দেয় না। ভক্তদের ব্যাপারে এলাকার মানুষ খুব আন্তরিক।’

ধামেই পাওয়া গেল গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ড পরিচালনা কমিটির সম্পাদক শ্যামাপদ সান্যালকে। তিনি বলেন, ‘খেতুরীধামের উৎসব নিয়ে এ এলাকার মানুষ যথেষ্ট আন্তরিক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কখনও এখানে বিশৃঙ্খলা হয়নি। শুধু প্রশাসন দিয়ে সবকিছু হয় না। স্থানীয়দেরও সহযোগিতা লাগে। এটা এলাকার মানুষ সব সময় দেন। ভক্তদের থাকার জন্য অনেকে নিজের ঘর ছেড়ে দেন। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে! এখানে যে মেলা বসে সেটা শুধু সনাতন বা বৈষ্ণব ধর্মের মানুষের নয়, সব ধর্মের মানুষই আসে।’

তিনি জানান, গতবছর অবরোধের কারণে উৎসবে ভক্তদের সংখ্যা কম ছিল। এবার কমপক্ষে পাঁচ লাখ ভক্ত সমবেত হবে বলে তারা আশা করছেন। ভক্তদের জন্য পর্যাপ্ত প্রসাদের ব্যবস্থা করছেন তারা। ভক্তদের জন্য এখানে এক সারিতেই করা আছে ৬২টি শৌচাগার।

গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াত বলেন, ‘উৎসব ঘিরে প্রতিবছর বসন্তপুর থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক থাকে। এবার পুলিশের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার জন করা হয়েছে। এ উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। এখানে নরোত্তম ভক্তরা এসে মুসলিমদের বাড়িতে থাকে পর্যন্ত। এবারও এই সম্প্রীতি বজায় থাকবে।’

গোদাগাড়ীর পদ্মা তীরের গোপালপুর গ্রামে রাজা কৃষ্ণানন্দের ঘরে নরোত্তম ঠাকুরের জন্ম ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে। বৈষ্ণব ধর্মীয় নেতাদের তথ্যমতে, তমালতলী এলাকায় পদ্মায় ডুব দিয়ে মহাপ্রভূর দীক্ষা পান রাজপূত্র নরোত্তম। পরে তিনি গরাণহাটি ঘরাণর প্রবর্তক মহাপুরুষ লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে বৃন্দাবন যান। কিন্তু লোকনাথ গোস্বামী কাউকে শিষ্য বানাবেন না বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। নরোত্তম তাঁর মন জয় করে লোকনাথের শিষ্যত্ব পেয়েছিলেন। তিনিই লোকনাথের প্রথম ও শেষ শিষ্য। শিষত্ব গ্রহণের পর খেতুরে ফিরে এসে তিনি এই আশ্রম করেছিলেন। ৮০ বছর বয়সে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের জিয়াগঞ্জের বুদুরিঘাটে দেহত্যাগ করেন। তখন থেকে নরোত্তম ভক্তরা প্রতিবছর লক্ষ্মী পূর্ণিমার পঞ্চমী তিথিতে খেতুরীধামে এসে সংকীর্ত্তনের মাধ্যমে তাদের নরোত্তম ঠাকুরকে স্মরণ করেন।