সারা বাংলা

মাদারগঞ্জের ৩ ফসলী আবাদি জমিতে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র

জামালপুরের মাদারগঞ্জে তিন ফসলী জমিকে অকৃষি দেখিয়ে প্রায় ৬৭৪ একর জমিতে স্থাপন করা হচ্ছে দু’টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে ঘর-বাড়ি, বসতভিটা ও জমিজমা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। 

এই উচ্ছেদ কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন সাতবারের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজম ও তার ছোট ভাই মির্জা সোহেল। এর বিরুদ্ধে যারা গেছেন, তাদেরকে নানা ধরনের নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিজ সংসদীয় আসনে মির্জা আজমের এমন হিংস্র ভূমিকা আগে দেখেনি স্থানীয়রা। এই ফসলি জমি ও বাড়িঘর রক্ষায় ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের কাছে স্বারকলিপি প্রদান করেছে তারা। 

প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্থদের পুর্নবাসনের পরই শুরু করা হয়েছে প্রকল্পের কাজ। আর জেলা প্রশাসক বলছেন- বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তারা।

জামালপুরের মাদারগঞ্জের কাইজারচরের চারিদিকে ছিল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সবুজের সমারোহে ভরা তিন ফসলি উর্বর এসব জমিতেই স্থাপিত হচ্ছে ২৮০ মেগাওয়াট ডিসি ও ২২০ মেগাওয়াট এসি ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার প্ল্যান্ট। এজন্য রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ৬৭৪ একর জমি। ‘মাদারগঞ্জ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র’ নামে এই প্রকল্পে দু’টি কোম্পানিকে ৩৪৮ একর ও ৩২৫ একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ৯৯ বছরের জন্য। এর জন্য সরকারকে দিতে হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। যদিও কাগজ-কলমে এই জমিকে দেখানো হয়েছে অকৃষি।

কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রায় ১০ হাজার জনগোষ্ঠী এখান থেকে উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করছি। আমাদের এখানকার এসব জমি থেকে ধান, ভূট্টা, মরিচ, পাট প্রভৃতি চাষ হয়। বাংলাদেশে যত প্রকার ফসল আছে সব ধরনের ফসলেরেই চাষ হয় এখানে।’

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অন্তত ১০ হাজার গরিব কৃষক হারাবে তাদের বসত বাড়ি ও তিন ফসলি আবাদী জমি। এ কারণে শুরু থেকেই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে গ্রামবাসী। অভিযোগ রয়েছে, অদৃশ্য লাভের কারণে ৬৭৪ একর জমিতে দু’টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন মির্জা আজম ও তার ছোটো ভাই মির্জা সোহেল। 

জমি দিতে রাজি না হওয়ায় গ্রামবাসীকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক নানা নির্যাতন। আর যারা এর প্রতিবাদ করেছেন তাদেরকে করা হয়েছে নানা ধরনের নির্যাতন। মির্জা আজমের নির্দেশে এসব কাজ করেছেন তারই ছোট ভোই মির্জা সোহেল ও তার লোকজন।

স্থানীয় বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যদি পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়, তাহলে কমপক্ষে আমাদের ১০ হাজার লোকের অনাহারে দিন যাপন করা লাগবে। জমি দিয়ে আমাদের পাওয়ার প্লান্ট দরকার নাই। এত লোকের তো আর কর্মসংস্থান দিতে পারবে না। অতএব আমরা কৃষক মানুষ, কৃষি কাজ করেই খাব।’

স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলে, ‘আমাদের এখানে যারা জমির প্রসঙ্গে, পাওয়ার প্লান্টের বিপক্ষে যারাই কাজ করতে গেছে। তাদের সবাইকে অত্যাচার করছে, কতজনকে মামলা দিয়ে অত্যাচার করছে, কতজনকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করছে। কতজনকে বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করেছে। মির্জা আজম ও তার ছোট ভাই এসব করেছে। যারাই আন্দোলন করছে, তাদেরকেই মারধর করা হয়েছে।’

মো. শাহিন আলম নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের ফসলের ভিতরে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে পূরণ করে ফেলছে। অনেক ধান হয়েছিল, ভূট্টা হয়েছিল। আমাদের ফসল নষ্ট করে ফেলেছে। আমরা কিছু বলতে গেলে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। কাউকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি।’

স্থানীয়দের অভিযোগ- অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করে ভরাট করা হচ্ছে ৬৭৪ একর জমি। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কায় রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি জমি রক্ষার্থে ও বৃহৎ স্বার্থে প্রকল্পটি অন্যত্র স্থানান্তরের দাবি সংশ্লিষ্টদের।

আইয়ুব আলী আকন্দ নামে একজন বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু দিয়ে এক জায়গা থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় ফেলতাছে। আমাদের বাড়ির সামনে থেকে নদী ও খাল কাইটে বাইর করতাছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা জুয়েল ইসলাম বলেন, ‘ওরা যেভাবে বালুগুলো ড্রেজার মেশিন দ্বারা তুলতেছে। উত্তোলন করছে। উত্তোলন করাতে আমাদের এখানে নদী বানিয়ে ফেলছে। যদি এভাবে বালু উত্তোলন করতে থাকে। তাহলে আশেপাশে যে বাড়িঘর আছে। প্রত্যেকটি বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বাংলাদেশ কৃষক কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা মনে করি কৃষি জমি রক্ষার প্রাইরোটি থেকেই এই প্রকল্পটা সরকারের বাতিল করা উচিত। অতীতের সরকারের যে ভুলভ্রান্তি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এই প্রকল্প বাতিল করা হোক। অথবা অন্যত্র স্থানান্তর করা হোক। এখানকার কৃষকদের তাদের জমি ফেরত দেয়া হোক। এটাই আমাদের দাবি।’

এদিকে, ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি মির্জা আজম ও তার ছোটো ভাই মির্জা সোহেলের সাথে। 

মাদারগঞ্জ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘যথাযথ নিয়ম মেনেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে সরকার স্বল্প সুদে ঋণ নিয়েছে এবং একনেক কর্তৃক অনুমোদিত। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রমও চলমান আছে।’

জামালপুরের জেলা প্রশাসক হাছিনা বেগম বলেন, ‘যদি আমরা যথা নিয়মে লিখিত কোনো আবেদন পাই, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা পাই- তাহলে ক্ষেত্র বিশেষে তদন্তপূর্বক জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’