সারা বাংলা

বরিশাল বিভাগে ব্যাপক ঝড়-বৃষ্টি, বসত ঘর বিধ্বস্ত, নিহত ১

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে বরিশাল বিভাগ জুড়ে ব্যাপক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলের নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে দুই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনও বিপৎসীমার ২২ সেন্টি মিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। 

এছাড়া বরগুনায় গাছ চাপায় আশ্রাব আলী (৬১) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। মাত্র এক মিনিটের ঝড়ে জেলার কাঠালিয়া উপজেলায় গাছ পড়ে মাদ্রাসা ও কয়েকটি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছে একটি গবাদী পশু। 

পটুয়াখালীতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাগর উত্তাল রয়েছে বন্দরে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টানা বৃষ্টিতে নাকাল বরিশাল, পিরোজপুর ও ভোলা’র মানুষের জন জীবন। দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলায় জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থা কমিটির প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র।

বরগুনা

বরগুনার বেতাগীতে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়ায় গাছ চাপায় আশ্রাব আলী (৬১) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার দুপুরে দিকে উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়নের কিসমত ছোট মোকামিয়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত আশ্রাব আলী হাওলাদার উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের কিসমত করুনা গ্রামের মৃত. জোনাব আলী হাওলাদারের ছেলে। তিনি পানের বরজে কাজ করতেন। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে দমকা বাতাসের পাশাপাশি হালকা থেকে ভারি বর্ষণ শুরু হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে থেকে থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে কিছুক্ষণ পর থেমে যায়। 

পাউবো জানিয়েছেন স্বাভাবিকের চেয়ে বরগুনার নদ-নদীর জোয়ারের পানি দেড় থেকে দুই ফুট বেশি উচ্চতায় জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে। 

বরগুনার জেলা প্রশাসক জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৫৩২ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য। এ ছাড়াও নগদ অর্থ রয়েছে ৯ লাখ টাকা। গঠন করা হয়ে ৪৯টি মেডিকেল টিম। স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন ৯ হাজার ৬১৫ জন। যারা ঘূর্ণিঝড় পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবেন। 

ঝালকাঠি

বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে ঝালকাঠিতে। এরমধ্যে মাত্র এক মিনিটের ঝড়ে জেলার কাঠালিয়া উপজেলায় গাছ পড়ে মাদ্রাসা ও কয়েকটি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছে একটি গবাদী পশু। শীতকালীন শাক-সবজি চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে।

বঙ্গপসাগর থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার নিকটবর্তী জেলার কাঠালিয়া উপজেলায় গত বুধবার থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নামে ভারি বৃষ্টি। হয় এক মিনিটের ঝড়।

আওরাবুনিয়া ইউনিয়নের ছিটকি নেছারিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ইদ্রিস মাঝি বলেন, ‘সকাল থেকেই বিরমাহীনভাবে বৃষ্টি শুরু হয়। বেলা ১১টা দিকে মাত্র এক মিনিটের ঝড়ো বাতাস হয়। ওই বাতাসে কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়ে আমার (নেছারিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা) টিনসেড মাদ্রাসা ভবনটি বিধ্বস্ত হয়।’

একই উপজেলার বড় কাঠালিয়া গ্রামের জেলে আলতাফ হোসেন জমাদ্দারের বসত ঘরও গাছ পড়ে বিদ্ধস্ত হয়। তিনি জানান, তার পাশের বাড়ির কৃষক আবু হানিফেরও গরু ঘরে গাছ চাপা পড়ে একটি গরু মারা গেছে।

পিরোজপুর

ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে সারাদিনই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পিরোজপুরে। সকালে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও, দুপুর থেকে হঠাৎ করেই কিছু সময় বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এরপর থেকেই সারাদিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পিরোজপুরে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে রাস্তাঘাটে যানবাহনের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ ছাড়া অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ ছিল। এছাড়া নদ নদীগুলোতে পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বরিশাল

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে বরিশালে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরিশালের আকাশ মেঘলা এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। 

বরিশাল আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে বৃষ্টিপাত আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে বরিশাল নগরীর বিভিন্ন সড়কে বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তবে বরিশাল নদী বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চ ও সব ধরনের নৌযান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ মোকাবেলায় বরিশাল জেলা প্রশাসন জরুরি প্রস্তুতি নিয়েছে। বরিশালে ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেখানে প্রতি কেন্দ্রে ৫০০ জন করে আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া ৭৯৮টি মাধ্যমিক ও ১৫৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় নগদ ১২ লাখ টাকা, ৫৬৯ মেট্রিক টন চাল, শিশু খাদ্যের জন্য ৫ লাখ এবং গো-খাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বরিশালের ১০টি উপজেলায় মেডিকেল টিমও প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও সিপিপির ৩২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, রেড ক্রিসেন্টের ২০০ স্বেচ্ছাসেবক, স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যরা এ কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন।

বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে এবং সেখানে শুকনো খাবার ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ শুরু করেছে।

পটুয়াখালী

ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে পটুয়াখালীতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হালকা বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন, বইছে দমকা হাওয়া। রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা।

নদ-নদীর পানির উচ্চতা কিছুটা বাড়লেও তা বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। জেলার চর আন্ডা ও চর মোন্তাজ এলাকায় যে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত রয়েছে সেখান থেকে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধ অবস্থায় মানবতার জীবন যাপন করছে সেখানকার কয়েক হাজার মানুষ। 

এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ১০ কিলোমিটার বেরিবাধ অংশে মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। পানির চাপে কোথাও কোনো বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা মেরামতের জন্য বিভিন্ন উপজেলায় ১৬ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

এদিকে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। বড় বড় ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। পর্যটকরা যেন সাগরে নামতে না পারে সেজন্য মাইকিং করে সচেতন করছে টুরিস্ট পুলিশ। সকল মাছধরা ট্রলার সমূহকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড় দানা মোকাবেলায় দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য জেলায় ৮২৯টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৩৫টি মুজিব কিল্লা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মজুদ করা হয়েছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার। স্বাস্থ্য বিভাগের ৭৫টি মেডিকেল টিম বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে। 

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বুধবার বেলা ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়াসহ ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলি গ্রামে প্রবল বাতাসের তোড়ে ৭টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় ৩ জন আহত হয়েছে। তাদেরকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। সাগর উত্তাল থাকার কারণে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সৈকতে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 

ভোলা ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে উত্তাল ভোলার নদী। দুর্ঘটনার আশংকায় বন্ধ রয়েছে লঞ্চ চলাচল। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। সময় বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া আরও বৈরী ভাব ধারণ করেছে। বৃষ্টি এবং ঝড়োবাতাস অব্যাহত রয়েছে। এদিকে ঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৭৮৯ টি আশ্রয় কেন্দ্র ১৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। 

বরিশাল পানি উন্নয় বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন ওয়ালিদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বরিশালের নদ-নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। এখনও কোথাও নদী ভাঙগনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে জরুরি প্রয়োজনে ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ প্রস্তুত রয়েছে।’