বরগুনার কৃষকদের জন্য সরকারের ৭০% ভর্তুকি দেওয়া শতশত কম্বাইন্ড হারভেস্টার গায়েব। যেসব কৃষকদের নামে হারভেস্টার ছাড় হয়েছে, তারা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কৃষি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ কেউ অদৃশ্য কৃষক আবার অনেকে তাদের স্বজনদের নামে ছাড় করিয়েছেন এই অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্র। এরপর থেকেই কৃষি যন্ত্রগুলোর হদিস নেই।
অন্যদিকে কৃষকের জন্য সরকারের ভর্তুকি দরে কেনা পাওয়ার টিলার ও সিডার কৃষিযন্ত্র বিক্রি করে রাতের আঁধারে পাঠানো হচ্ছে উত্তরাঞ্চলে। গত তিন অর্থবছরে বরগুনায় বিভিন্ন কৃষকদের নাম দেখিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব কৃষিযন্ত্র পাচার করছেন একটি চক্র।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, তালতলী, বরগুনা সদর, পাথরঘাটাসহ গোটা জেলার কৃষিযন্ত্র পাচার হচ্ছে খুলনা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
তীব্র শ্রমিক সংকটে যখন গোটা উপকূলের কৃষকরা, তখন কৃষি নির্ভরশীল বরগুনা জেলায় সরকার ৭০% ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের জন্য নিয়ে আসে কম্বাইন্ড হারভেস্টার। একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মূল্য কোম্পানি ভেদে ৩০ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। যার ২১ থেকে ৩০ লাখ টাকা দিচ্ছেন সরকার। বাকি মাত্র ৯ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা দিচ্ছেন কৃষক।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই হারভেস্টার দিয়ে ঘণ্টায় এক একর জমির ধান বা গম কাটা থেকে বস্তাবন্দী করা যায়। এতে করে প্রতি একরে জ্বালানি খরচ হয় মাত্র ১২ লিটার ডিজেল। কৃষকদের জন্য সরকারের এই সুবিধার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ কৃষি অফিস।
বরগুনা সদর কৃষি অফিসের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে বরগুনা সদরের আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের জসিম উদ্দিন পেয়েছেন একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার। তবে, জসিম উদ্দিন বলছেন, তাকে হারভেস্টার দেওয়ার কথা বলে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়েছেন কৃষি অফিসের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট প্ল্যান প্রোটেকশন অফিসার মো. মুনিরুজ্জামান এবং উপ-সহকারি কৃষি অফিসার ইলিয়াছুর রহমান। কিন্তু এরপর হারভেস্টার চোখে দেখেননি তিনি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সদরের এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের আজিজাবাদ এলাকার আব্দুস ছাত্তার ও বারেক হাওলাদার পেয়েছেন দুটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার। তবে, এই হারভেস্টার দুটোও গায়েব।
আব্দুস ছাত্তার বরগুনা সদর ইউনিয়নের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের বাবা। বারেক হাওলাদারও তার নিকট আত্মীয়। আব্দুস ছাত্তার ও বারেক হাওলাদারের স্ত্রী বলছেন, জসিম উদ্দিন কৃষি অফিসে চাকরিরত, তাই তার নিজ নামে হারভেস্টর ছাড়াতে না পেরে তাদের নাম ব্যবহার করেছেন। এছাড়া কিছুই জানেন না তারা।
একই অবস্থা আমতলী, তালতলী পাথরঘাটাসহ গোটা জেলাজুড়ে।
তালতলী উপজেলার বাদুরগাছা এলাকার দর্জি নাসির উদ্দিন। ভাঙা এই ঘরে বসবাস করেন তিনি। কৃষি অফিসের নথি বলছে ৩২ লাখ টাকা মূল্যের একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার পেয়েছেন নাসির। তার প্রতিবেশি ও স্বজন মাহমুদুল হাসান ওরফে সবুজের মাধ্যমে কৃষি কর্মকর্তা তার কাছ থেকে নিয়েছিলেন ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। এক বছর পর জানতে পারেন তিনি একটি হারভেস্টারের মালিক।
এলাকার কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কৃষি কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ট মাহমুদুল হাসান সবুজ ও কৃষি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভৌতিক কৃষকদের তালিকা করে হারভেস্টার ছাড় করে বিক্রি করেন তারা।
কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, জেলার ৬ উপজেলায় তিন অর্থবছরে মোট কম্বাইন্ড হারভেস্টার এসেছে ৩৩১টি এবং পাওয়ার থ্রেসার ২১৫টি। তিন অর্থবছরে জেলায় হারভেস্টার ও পাওয়ার থ্রেসারে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় একশ কোটি টাকা। তবে, যাদের জন্য সরকার এই ভর্তুকি দিচ্ছেন সেসব কৃষকরা এর সুবিধা পাননি।
তালতলী উপজেলার বাদুরগাছা এলাকার কৃষক আসমত আলী বলেন, কাগজে কলমে শুধু দেখি ধান কাটা মেশিন বরাদ্দ। কিন্ত আমরা কৃষি অফিসে বছরের পর বছর ঘুরেও পাইনা। গত মৌসুমে আমি উত্তরাঞ্চল থেকে হারভেস্টার ভাড়া করে এনে আমার ১২ একর জমির ধান কাটিয়েছি।
সদরের বুড়িরচর এলাকার কৃষক বারেক হাওলাদার, মিঠুন হাওলাদার বলেন, আমাদের এলাকায় নাকি অনেক কৃষক হারভেষ্টার পেয়েছেন। আমি শুধু শুনেছি। কিন্ত দেখিনি। আমরা ধান কাটার সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে হারভেস্টার ভাড়া এনে বাড়তি খরচ দিয়ে ধান কাটাই। শ্রমিক সংকটের কারণে আমরা হারভেস্টার এর উপর নির্ভরশীল।
এসব বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কৃষিযন্ত্রের কারসাজিতে জড়িত ইউনিয়নে কর্মরত কৃষি কর্মকর্তা যাদেরকে পাওয়া গেছে তারা বলছেন ভিন্ন ভিন্ন কথা। কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি তাদের।
বরগুনা সদর কৃষি অফিসের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট প্লান প্রোটেকশন অফিসার মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, আমি জসিমকে চিনি না। আমার নামে মিথ্যা বলছে। যারা কৃষিযন্ত্র নিয়েছে তাদের স্বাক্ষর আছে তালিকায়।
বরগুনা সদর কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন ও তালতলীর সাবেক উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, তারা এসবের সাথে জড়িত নেই।
এদিকে কৃষিযন্ত্র সিডার ও টিলার বিক্রি ও উত্তর অঞ্চলে পাচারের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাতের আঁধারে কৃষিযন্ত্র ট্রাকে করে পাচার হচ্ছে। অথচ কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের জন্য সরকার উপকূলের কৃষকদের জন্য কৃষি যন্ত্র সিডার ও টিলারেও সরকার ৭০ ভাগ টাকা দিয়ে কৃষকদের থেকে নিচ্ছে মাত্র ৩০ ভাগ টাকা। কিন্তু সেসব সুবিধা কৃষক পাচ্ছে না। এই উপকূলের প্রান্তিক কৃষকরা এখনো আদি যুগের মতোই গবাদি পশু দিয়ে জমির চাষ দিচ্ছেন আবার যারা একান্তই গরিব তারা ফসলি মাঠের জমি প্রস্তুত করছেন গায়ে খেটে।
তালতলীর বাদুরগাছা এলাকার কৃষক মনিরুজ্জামান হারুনের মতো অনেক কৃষক একটি পাওয়ার টিলারের জন্য ঘুরেছেন উপজেলা কৃষি অফিসে। তবে, তাদের ভাগ্যে জোটেনি এই কৃষি যন্ত্র। তাই কিস্তিতে ১লাখ ৮৭ হাজার টাকায় কিনেছেন পাওয়ার টিলার।
মনিরুজ্জামান হারুন বলেন, ধারদেনা করে আমি ১০ একর জমির চাষের জন্য পটুয়াখালী থেকে টিলার কিনেছি। কিন্তু কৃষি অফিসে বার বার চেষ্টা করেও আমি টিলার পাইনি।
তবে, মনিরুজ্জামানের প্রতিবেশি সবুজ হাওলাদারের বাড়িতে পাওয়ার টিলার সহ কৃষি যন্ত্রের সমাহার। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, তালতলীর গোটা কৃষি অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন এই সবুজ হাওলাদার।
সবুজ হাওলাদারের সাথে স্থানীয় এক কৃষকের কথোপকথনের ভিডিওতে দেখা যায়, সবুজ হাওলাদার গোমর ফাঁস করেন কৃষি অফিস ও কৃষিযন্ত্র বিক্রি করা কোম্পানিগুলোর। সবুজের ভাষ্যমতে, কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কৃষি অফিসের যোগসাজশে কৃষিযন্ত্রগুলো উত্তর অঞ্চলে পাচার করে ৫০ভাগ ভর্তুকি দরে ফের বিক্রি করে কৃষকদের কাছে। বিনিময়ে প্রতি যন্ত্র হিসেব করে ভাগ দেয় কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের।
এই উপজেলা ঘুরে হাতে গোনা যে’কটি কৃষিযন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সরকারের ভর্তুকি দরে কেনা সেসব কৃষিযন্ত্র কৃষকরা ক্রয় করেছেন সবুজ হাওলাদারের থেকে।
উপজেলাগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ভর্তুকি দরে কৃষি যন্ত্র ছাড় হয়েছে কৃষকদের নামে।
বরগুনা সদরের দক্ষিণ ইটবাড়িয়া গ্রামের ফরিদ মিয়া ও তার ছেলে মো. আকাশ ভর্তুকি দরে পেয়েছেন দুটি সিডার ও দুটি পাওয়ার টিলার। তবে, বাবা-ছেলে দুজনেই যে কোম্পানি থেকে কৃষিযন্ত্র সরকারের দেওয়া ভর্তুকি দরে কিনেছেন, সেই কোম্পানির কাছেই বিক্রি করেছেন চারটি কৃষিযন্ত্র। বাবা প্রকৃত কৃষক হলেও ছেলে ধারে কাছেও নেই কৃষি কাজের। অন্যদিকে কৃষিযন্ত্র পাবার আগে থেকেই স্বচ্ছল এই কৃষক একটি সচল পাওয়ার টিলারের মালিক।
একটি সিডার ও পাওয়ার টিলার পেয়েছেন সদরের পূর্ব কেওড়াবুনিয়া এলাকার শহিদুল ইসলাম। তিনিও বিক্রি করেছেন কৃষিযন্ত্র দুটি। ফরিদ মিয়া, আকাশ ও শহিদুল ইসলামসহ গোটা আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নে কৃষিযন্ত্র কারবারির মূলহোতা সদর কৃষি অফিসেরই কয়েকজন। এরা কৃষিযন্ত্র পাচারের বলয় গড়ে তুলেছেন।
এছাড়া আমতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাসহ জেলায় তিন অর্থ-বছরে নামে-বেনামে বরাদ্দ হয়েছে ১৬৮৪টি সিডার ও পাওয়ার টিলার। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা। এ সব কৃষিযন্ত্র পাচার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
কৃষকরা কেনো ভোগ করতে পারছে না অত্যাধুনিক কৃষিযন্ত্রের সুফল, এমন প্রশ্নের উত্তর মিলবে ভর্তুকি দরে যন্ত্র কেনার কৃষকদের চূড়ান্ত তালিকা করেন কারা, তাদের কাছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী কৃষকরা আবেদন করার পর বাছাই কমিটির- সভাপতি স্ব স্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য সচিব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম মিঞা ও সদ্য বিদায়ী তালতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত আনোয়ার তুমপা বলছেন, কৃষক বাছাই কমিটির পুরো কাজটাই করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা। মাঠ পর্যায়ের তথ্য কৃষি অফিসের কাছে থাকে। কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তা কৃষি অফিস নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে। তাহলে প্রকৃত কৃষকরা তিন অর্থবছরে কেনো কৃষি যন্ত্র পায়নি। এর পিছনের কারণ বাছাই কমিটির সদস্য সচিব অর্থাৎ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা।
এই তিন অর্থবছরে সদস্য সচিব ছিলেন- বরগুনা সদরে মোস্তাফিজুর রহমান, পাথরঘাটা উপজেলায় শিশির কুমার বড়াল, তালতলী উপজেলায় সুমন হাওলাদার ও আমতলী উপজেলায় সি এম রেজাউল করিম। তারা সবাই বদলি হয়েছেন বিভিন্ন উপজেলায়।
বরগুনা সদরের সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্র সিন্ডিকেট করে কৃষিযন্ত্র পাচার করছে। তবে, এসবের সাথে তিনি জড়িত নন।
পাথরঘাটার সাবেক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিশির কুমার বড়াল বলেন, এসব কিছু মনে নেই তার। তিনি বদলি হয়েছেন।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বলেন, কৃষকের তালিকা থেকে যন্ত্র বিতরণের সব কাজটাই করেন উপজেলা কৃষি অফিস ও প্রকল্প পরিচালকরা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা।
কৃষি নির্ভরশীল উপকূলীয় এই জেলায় কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৮৬ জন। তাদের মধ্যে এখনো আদি পদ্ধতিতে ফসলি মাঠ প্রস্তুত করেন প্রায় ৪০ ভাগ কৃষক, আর বাকি কৃষকদের মধ্যে বেশিরভাগরাই কৃষিযন্ত্র ভাড়া করে আনেন উত্তরাঞ্চল থেকে।