কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে শাহেদা আক্তার রিপা। একসময় যার নাম কেবলমাত্র স্থানীয় মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, আজ সেই নাম গোটা দেশকে আলোড়িত করেছে। নারী ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ক্রীড়াজগতে নতুন তারকা হয়ে জন্ম নিয়েছেন তিনি। দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা এবং সমাজের কঠিন বাধা পেরিয়ে রিপা আজ বাংলাদেশের গর্বে পরিণত হয়েছেন।
রিপার শৈশব কেটেছে দারিদ্রতায়। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না কখনোই। তবুও মা-বাবা, বড় ভাই কখনোই রিপাকে থেমে যেতে দেননি। খেলার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে রিপা এগিয়ে গেছেন। গ্রামের রীতি- নীতির কারণে মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলা চালিয়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) রিপার গ্রামের বাড়ি উখিয়া উপজেলার সোনাই ছড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে বড় ফুটবল মাঠ। সেখান থেকেই নিজেকে প্রস্তত করে আজ রিপা নারী ফুটবল তারকা। প্রতিবেশীরা মাঠের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, এই মাঠেই আমাদের রিপা খেলতো, খেলার সঙ্গী হিসেবে কাউকে না পেলেও একা একা চর্চা করত।
ফাইল ফটো
রিপার বাবা জালাল আহমদ বলেন, ‘রিপার সাফল্যে শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, প্রতিবেশী ও এলাকার মানুষরাও আনন্দিত। তার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান শিক্ষক সানা উল্লাহ ও শামশুল আলম সোহাগের। প্রতিবেশীদের দোয়া, আন্তরিক ভালোবাসা ও উৎসাহ রিপাকে আজ এতদূর পর্যন্ত যেতে সহযোগিতা করেছে।’
প্রতিবেশী মোহাম্মদ সৌরভ হোসাইন বলেন, “আমাদের গ্রামের মেয়ে দেশের হয়ে নেপালে খেলতে গেল, তাও আবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের মতো বড় আসরে। এটি গ্রামবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর। প্রথম প্রথম সে যখন মাঠে খেলতে যেত অনেকেই অনেক কথা বলতেন। ‘মেয়ে কেন ছেলেদের খেলা খেলবে, ছেলেদের মতো দৌঁড়াবে, হেনতেন।’ এসব তোয়াক্কা না করে রিপা নিজেকে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল। আজ সে সফল। গ্রামের মানুষরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে রিপাকে উৎসাহ দিচ্ছে। রিপার খেলা চললে গ্রামের সবাই হৈ-হুল্লোড় করে খেলা দেখতে বসে।”
প্রতিবেশী ইউসুফ জালাল বলেন, ‘রিপার বাড়ির পাশেই খেলার মাঠ। পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় মাঠ দাপিয়ে বেড়াত মেয়েটি। আজ গ্রামবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছে রিপা। তিনি এখন আমাদের দেশের গর্ব। আমরা সবাই তার জন্য দোয়া করছি।’
রিপার বড় ভাই ফারুক হোসাইন বলেন, ‘আদরের বোন রিপাকে এ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পথ সহজ ছিল না। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। শুরু থেকে ফুটবলে রিপার দক্ষতা, অদম্য আগ্রহ আর শূন্য থেকে একে একে সফলতা রিপাকে জাতীয় দলে নিয়ে গেছে। মা-বাবা, শিক্ষক-আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ছিল। আমরাও জানতাম না আসলে ফুটবলে নারীদের একটা ভবিষ্যৎ আছে। তা প্রমাণ করে দিয়েছে কলসিন্দুরের তহুরা, মারিয়া, সানজিদা, শামসুন নাহাররা। তাদের খেলা দেখে স্বপ্ন জাগে আমাদের রিপাও একদিন জাতীয় দলের হয়ে দেশের জন্য খেলবে। দেশের ফুটবলকে রাঙাবে। সেই অদম্য স্পৃহা থেকে হাল ছাড়িনি। আজ রিপার খেলা দেখতে গ্রামবাসীর আগ্রহ থাকে তুঙ্গে। আমার কাছে তারা জিজ্ঞেস করে রিপার খেলা কবে দেখা যাবে। এই বিষয়গুলো খুবই ভালো লাগে। তখন মনে হয় আমাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে।’
কক্সবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অনুপ বড়ুয়া অপু বলেন, ‘রিপার এই অর্জন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। সাফল্যের এই গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ যেকোনো বাধাকে জয় করতে পারে। অনেকে তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে, বিশেষ করে যারা দারিদ্র্য বা সমাজের নানা বাধার কারণে নিজেদের স্বপ্নকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। রিফা তাদের জন্য এক জীবন্ত উদাহরণ।’
প্রসঙ্গত, নেপালকে হারিয়ে আবারও ‘সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৪’ এর শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ দল। গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতে কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা শোকেসে তোলে বাংলাদেশের মেয়েরা।