বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠি নিয়ে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ চিঠিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে তার সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে বিএনপি নেতা আশরাফ উদ্দিন নিজানের সমর্থকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদিও দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এর সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই।
চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় জেএসডি নেতাকর্মীরা সরব হয়েছেন। দুই দলের সমর্থকরা তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে আ স ম রবকে সহযোগিতার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তৃণমূলের মধ্যে জল্পনার জন্ম দেয়। আসন্ন নির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়ন পেতে পারেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ স ম আব্দুর রব। ফলে বিএনপি কেন্দ্রীয় সহশিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন নিজান অনুসারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
লক্ষ্মীপুর বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০০১ ও ২০০৮ সালে টানা দুই বার বিএনপি নেতা আশরাফ উদ্দিন নিজান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার হাত ধরে ২০০৬ সালে বৃহত্তর রামগতি উপজেলাকে ভাগ করে কমলনগরকে নতুন উপজেলা করা হয়। ২০১৪ সালের বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে ধানের শীষ প্রতীকে আ স ম রব প্রার্থী হন। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের রাতের ভোটে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে আ স ম আব্দুর রব ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময়ে জাতীয় সংসদের তিনি বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাসদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। ফলশ্রুতিতে তিনি শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায় ২৯ জুন, ১৯৯৬ থেকে ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮ থেকে ১৫ জুলাই, ২০০১ সাল পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালের পঞ্চম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে পরাজিত হন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে জামানত হারান এ নেতা। তিনি রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের বাসিন্দা।
জেলা বিএনপিকে দেওয়া রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সংসদীয় এলাকায় জনসংযোগ ও তার দলের কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য আপনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় এলাকার থানা, উপজেলা বা পৌরসভা বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিষয়টি অবহিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে আপনাদের অনুরোধ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলনগর ও রামগতি উপজেলার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, আ স ম রব দীর্ঘ দিন জনগণ থেকে দূরে রয়েছেন। এলাকার মানুষের খোঁজ-খবরও নেননি। রামগতিতে জমিদারহাট বাজারের অদূরে তিনি স্টেডিয়াম ও বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য নামফলক উন্মোচন করেছেন। তা ফলকেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নেতারা ওই জমি দখলে নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়েছেন। এখন রব সাহেবের বয়স হয়েছে। তিনি এলাকাতেও তেমন আসেন না। তার দলীয় নেতাকর্মী কিংবা সমর্থন খুবই কম। এ সব বিষয় নিয়ে দুই দলের নেতাকর্মীরা ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কমলনগর উপজেলা শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান মানিক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন আশরাফ উদ্দিন নিজান। এ জন্য তিনি এলাকায় জনপ্রিয়। দল থেকে আ স ম রবকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জেএসডির কমলনগর উপজেলা কমিটির সভাপতি আবদুল মোতালেব বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর থেকে জেএসডি বিপ্লবী জাতীয় সরকারের দাবি করে আসছে। ওই সময় বঙ্গবন্ধু কথা রাখেননি। ৭২ সালের পর ২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি জাতীয় সরকার গঠনের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতারাই বলতে পারবেন আ স ম আবদুর রবের জন্য কেন চিঠি দিয়েছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা ঘটনাটি বিতর্কিত করার জন্য বিভিন্ন কথা বলছেন। তাদের ৩১ দফার সঙ্গে আমাদের ১০ দফার মিল রয়েছে। গত ১৭ বছর আ স ম আবদুর রব আন্দোলন করেছেন। তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক। তিনি জাতীয় বীর। তিনি নদী ভাঙন নিয়েও কাজ করেছেন কিন্তু বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে তা সম্পন্ন করতে পারেননি।’
রামগতি উপজেলা বিএনপির ১ম যুগ্ন আহ্বায়ক দিদারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ভিপি নুরসহ আন্দোলনে ছোট ছোট যেসব দল সহযোগিতা করেছেন, তাদের সহযোগিতা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা এলাকায় গিয়ে উদ্ভট কথা-বার্তা বলেন। এতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, আ স ম রব বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। তাকে সমর্থন দিলে কোনোভাবে তৃণমূল নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ করবে না। এ ক্ষেত্রে আশরাফ উদ্দিন নিজান স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও জয়ী হবে।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা আশরাফ উদ্দিন নিজান বলেন, এমন চিঠি ৬৪টি জেলায় দেওয়া হয়েছে। যেসব দলে তৃণমূলে জনসমর্থন নেই, তারা কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে দল থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের কেউ বাঁধা-বিপত্তি না দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব দল সবল তারা আবেদন করেননি, এ জন্য তাদের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়নি।
আ স ম আব্দুর রবকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আপনি নির্বাচনে অংশ নিবেন কি-না এমন প্রশ্নে আশরাফ উদ্দিন নিজান বলেন, ‘দল থেকে এমন কিছু আমি আশাও করি না। আ স ম রব আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন। তাকে তো কোনোভাবে তৃণমূল বিএনপি মেনে নিতে পারবে না। এছাড়া যতটুকু জানি আ স ম রব কোনো প্রার্থী নন।’
এ বিষয়ে জানতে আ স ম আবদুর রবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। তবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকার পতন আন্দোলনসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দল জেএসডি। দীর্ঘ যুগপৎ আন্দোলনে, রাজপথে, প্রতিবাদে, বিক্ষোভে, মিছিলে, অবরোধে, হরতালে ও সংগ্রামে জেএসডি সভাতি আ স ম আব্দুর রবের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।’ বিএনপির দেওয়া চিঠিটিকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে দেখছেন এ নেতা।
লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান বলেন, আব্দুর রব সাহেব একজন জাতীয় নেতা। দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। তিনি এলাকায় আসলে যেন অসম্মানিত না হন, সেজন্য কেন্দ্র থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।