স্বামীর সঙ্গে চার বছর আগে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার মসজিলপুর এলাকায় আসেন ফাতেমা আক্তার (৬০)। কষ্টে উপার্জিত টাকায় একটু একটু করে কেনেন আসবাবপত্র। সাজিয়ে তোলেন নিজের সংসার। তার সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখনও আসবাবপত্রের ছাই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। চারিদিকে শুধু ছাই আর ছাই, বিধ্বস্ত একটি বাড়ি।
জীবনের সব সহায়-সম্বল বিক্রি করে ঘরটি তিনি তৈরি করেন ফাতেমা। ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র, আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনটা কী? বুঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। চারিপাশে আগুনে পোড়া ছাই। অবশিষ্ট নেই কিছুই। পোড়া ঘরে দিন কাটে বৃদ্ধা ফাতেমার।
একটি ছেলে, স্বামী নিয়ে থাকতেন ফাতেমা। স্বামী একটি ফ্যাক্টরিতে অল্প টাকা বেতনে চাকরি করে। তার বড় মেয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তিনজনের ছোট্ট সংসার ছিল। তবে এক রাতের মধ্যে সব হারিয়ে ফুটপাতে ঠাঁই মিলেছে পরিবারটির।
গত অক্টোবর মাসের ২ তারিখ মধ্যরাতে ফাতেমার বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে তার ১২ লাখ টাকা মূল্যের বসতবাড়ি পুড়ে গেছে এবং দুষ্কৃতিকারীরা স্বর্ণের গহনাসহ ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে। ফাতেমা অভিযোগ করেন, ৩০ হাজার টাকা চাঁদা না দেওয়ায় মজলিশপুরের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় ফাতেমা নিজে বাদী হয়ে শিবপুর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার এক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
৬০ বছরের বৃদ্ধ ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমি কষ্ট করে তিলে তিলে একেকটা জিনিস গড়েছিলাম। একটা ফ্রিজ ছিল, একটা টিভি ছিল, খাট-শোকেস ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরনের কাপড়টা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। ৪ বছর ধরে আমি এই ঘরে ছিলাম। এখন স্মৃতি সব ছাই। পোড়া ঘরের দিকেই চেয়ে থাকি, দিন কেটে যায়…। এখানেই থাকি সারাক্ষণ, হাঁটি। আর দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরে। এখন কিছু নেই আমার। তিলে তিলে নিজের জমানো জীবনের শেষ টাকা দিয়ে বাড়িটি করেছিলাম। কত কষ্ট করতে হয়েছে, আমি জানি। ৩০ হাজার টাকা চাঁদা না দেওয়ার কারণে আমার স্বপ্নটাকে এভাবেই পুড়িয়ে দেওয়া হলো।’
তিনি বলেন, ‘বাড়ি পুড়ানোর এক মাস অতিক্রম করছে। এর মধ্যে একজন আসামিকেও পুলিশ ধরেনি। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মামলা উঠানোর জন্য। না হলে আমাকে মেরে ফেলবে। বার-বার পুলিশের কাছে গিয়েও আমি বিচার পাচ্ছি না। আজ আমার কেউ নেই বলে, পুলিশও আমায় সাহায্য করছে না।’
ভুক্তভোগী ফাতেমা আক্তারের স্বামী সিরাজ মিয়া বলেন, ‘শিবপুরে মজলিসপুর গ্রামের চিহ্নিত সন্ত্রাসী হানিফা, মনির, আলতাফ, শামসুল, রতু, লংকু, জনি, আরিফ আমার ছেলে মোবারক হোসেনের কাছে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও মেরে ফেলার হুমকিও দিতে থাকেন তারা। হানিফা ও মনির বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের হুমকি দিতে থাকেন। তাদের ভয়ে আমরা সবাই বাসা ছেড়ে দেই। এই সুযোগে ২ তারিখ রাত ১২টার দিকে তারা বাসায় ঢুকে তালা ভেঙে আলমারি থেকে স্বর্ণ ও নগদ ৪০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার পর আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবনের সর্বশেষ সম্বল, সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা দিয়ে বাড়িটা তৈরি করেছিলাম। বাড়িটি পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে এখন পথে বসেছি।’
শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। একমাসেও কেন কোনো আসামি গ্রেপ্তার হলো না— এ প্রশ্নের সদুত্তর দেননি তিনি।
শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, ‘কয়েকদিন হলো আমি যোগ দিয়েছে। খোঁজখবর নিচ্ছি। এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
নরসিংদী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান বলেন, তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।