প্রশাসনের নজরদারির অভাবে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আহাদী হোসেন যেনো দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে ঘুষ নিলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন এ কর্মকর্তা।
সিংগাইর উপজেলার ইউনিয়নগুলোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর তদারকি করেন আহাদী হোসেন। অভিযোগ উঠেছে এ তদারকির সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিটি প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেন ঘুষের টাকা। টিআর, কাবিখা, কাবিটা, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থানসহ সকল প্রকল্প থেকেই হাদিয়া নেন পিআইও আহাদী হোসেন।
জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, পিআইও আহাদী প্রতি প্রকল্প থেকে অফিস খরচের নামে টাকা নেন। ফলে উন্নয়ন কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তবে, এসব প্রকল্প থেকে ঘুষ নেওয়ায় অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন পিআইও আহাদী হোসেন।
সিংগাইর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহাদী হোসেনের অধীনে বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য চেয়ে ২৬মে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন এ প্রতিবেদক। তবে পিআইও আহাদী হোসেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করেননি।
পরে মানিকগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয়ে আইনানুগভাবে আপিল আবেদন করলে আপিল কর্তৃপক্ষ পিআইও আহাদীকে তথ্য প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করেন। এ নির্দেশনার পরেও আহাদী হোসেন তথ্য সরবরাহ করতে কালক্ষেপণ করেন। পরে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয়ে অনুরোধ করলে পুনরায় সিংগাইর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে তথ্য প্রদান করতে মৌখিক নির্দেশ দেন।
এমন নির্দেশনার পর সিংগাইর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহাদী হোসেন আংশিক তথ্য সরবরাহ করেন।
তার সরবরাহ করা তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করে রাইজিংবিডি। সিংগাইর উপজেলায় টিআর, কাবিটা, কাবিখা, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিসহ একাধিক প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে- অধিকাংশ প্রকল্পেই পূর্ণাঙ্গ কাজ করা হয়নি। আংশিকভাবে কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে।
এসব প্রকল্পের প্রকল্প সভাপতিদের ভাষ্য, পিআইও অফিস থেকে বরাদ্দের টাকার পনের থেকে বিশ শতাংশ টাকা অফিস খরচের নামে দিতে হয়। এ ছাড়া মাস্টাররোলেও খরচ করতে হয়। শুধুমাত্র মসজিদ, মাদ্রাসার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় পাওয়া যায়।
সিংগাইর উপজেলার বায়রা, ধল্লা, চারিগ্রাম, বলধারা ও চান্দহর ইউনিয়নের একাধিক প্রকল্প সভাপতির সাথে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। এসব প্রকল্প সভাপতিরা সবাই ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য।
বায়রা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য ও প্রকল্প সভাপতি দেওয়ান তছলিম উদ্দিন বলেন, ‘পিআইও আহাদী হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার সাহস কারো নেই। কারণ পিআইও অফিসে ঘুষ বাণিজ্য অপেন সিক্রেট। ঊদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন জানে প্রতি প্রকল্প থেকে অফিস খরচের নামে পিআইও অফিস টাকা নেয়। পিআইও-সহ তার অধীনে সবাই এ ঘুষ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। যেখানে প্রশাসনের সিনিয়ররা ব্যবস্থা নেন না, সেখানে ইউপি সদস্যরা অভিযোগ করে বিপাকে পড়তে যাবেন কেন?’
বলধারা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য আক্কাস আলী বলেন, ‘পিআইও আহাদী রাস্তাঘাটের প্রকল্প থেকে ঘুষের টাকা ঠিকমতো নিলেও মসজিদ-মাদ্রাসার প্রকল্প থেকে ঘুষের টাকার জন্য তেমন জুলুম করেন না।’
এক প্রশ্নে বেশিরভাগ প্রকল্প সভাপতিরা বলেন, ‘প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্প সভাপতিদের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা থাকে না। ফলে প্রতি প্রকল্পের সভাপতিরা থাকেন সবচেয়ে বেশি বিপদে। একদিকে পিআইও অফিসে টাকা দিতে হয়, অপরদিকে নিজের জন্য কিছু রাখতে হয়। আবার কাজটাও ঠিকঠাক করতে হয়। তবে এসব প্রকল্প থেকে পিআইওর পকেট বেশি ভারি হয়।’
পিআইও আহাদীর ঘুষ বাণিজ্য থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে তারা জানান- জেলা প্রশাসন, জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সকল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পিআইও অফিসে নজরদারি বাড়ালে এমন অনিয়ম কমে যেতো। এছাড়া অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারলে দুর্নীতি কমবে। পিআইও আহাদীর দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে গ্রামীন জনপদ উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ সুফল পাবে। এই পিআইওর আমলে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, ‘একজন সংবাদকর্মীকে সরবরাহযোগ্য তথ্য প্রদান করা একজন সরকারি কর্মকর্তার নৈতিক দায়িত্ব। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন ও আপিলের পরেও তথ্য প্রদান না করা বা কালক্ষেপণ করা দুর্নীতির ইঙ্গিত বহন করে। তার এমন কর্মকাণ্ড সংশোধনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিষয়টি সার্ভিস বুকে লিপিবদ্ধ করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই সাথে পিআইও আহাদীর তদারকিতে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়ধীন প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম হয়েছে কি না সে বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখে অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে সিংগাইর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আহাদী হোসেন বলেন, ‘দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে তথ্য দিতে দেরি হয়েছে। আর প্রকল্প তালিকায় প্রকল্প সভাপতিদের নাম লিপিবদ্ধ না থাকায় সেটি দেওয়া সম্ভব হয়নি।’
৪০ দিনের কর্মসূচির অভিযোগের বিষয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শ্রমিকদের দেওয়া তালিকা ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে শ্রমিকদের একাউন্টে টাকা চলে যায়। এ ছাড়া চলতি বছর ৩১ শতাংশ টাকা এবসেন্স দেখানো হয়েছে। সেই টাকা সরকারি ফান্ডে চলে গেছে। এই টাকা না পেয়ে অনেকে মনে করেন টাকা আমরা নিয়েছি। এটা ভুল ধারণা, এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাথী দাস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘এ বিষয়ে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’